সাম্প্রতিক পোস্ট

স্কুলটি কি সত্যিই চলে যাবে নদীগর্ভে ?

আব্দুর রাজ্জাক, মানিকগঞ্জ ॥

যেখানে কেটেছে ছোট্ট শিশু জীবনের ৪টি বছর। পরম মমতার প্রতিচ্ছবি প্রিয় বিদ্যালয়। অনেকগুলো প্রিয় মুখের বন্ধুত্ব; বন্ধন; চারণভূমি। আর শিক্ষকদের ভালোবাসা মিশ্রিত সোহাগ; রাগ; শাসন। সকাল থেকে বিকেল কিংবা ঝাঁঝালো দুপুর প্রতিনিয়তই স্পর্শ লেগেছে যে আঙিনায়। মায়ের হাত ধরে স্কুলে যাবার পথে দূর থেকে দেখেই চিৎকার করে বলতো, “মা; ওই যে আমাদের স্কুল”। আর বিদ্যার্জনের সেই আঁতুড় ঘর থেকে মাত্র ১০ ফুট দূরে অবস্থান করছে উত্তাল পদ্মা। একের পর এক ঢেউ আছড়ে পড়ছে পাড়ে। ঢেউয়ের তালে একটু একটু করে নিঃশেষ হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে নদীর ভেতর। চতুর্থ শ্রেণীতে পড়–য়া রাকিব স্কুলে এসেই থমকে দাঁড়ায়। ভয়ার্ত নয়নজোড়া একবার তাকায় প্রিয় স্কুলে তার ক্লাসরুমের পানে আরেকবার তাকায় আগ্রাসী পদ্মার ফেনিল ঢেউয়ের দিকে। কোন কিছুতেই মনকে বোঝাতে ব্যর্থ হওয়া রাকিবের মতো আরো দেড় শতাধিক প্রিয় শিশু শিক্ষার্থীর বর্ণমালার কলরবে আর কি মুখরিত হবে না এই বিদ্যালয়। না কি ইতিহাসের অতল মঞ্চেই এ স্কুলের যবনিকা পর্ব লেখা থাকবে?

manikgonj

ভাঙন রোধে দ্রুত কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নিলে যেকোনো সময় বিদ্যালয়টি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। এতে বিদ্যালয়ের দেড় শতাধিক শিক্ষার্থীর পড়ালেখা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। চোখের সামনে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে প্রিয় বিদ্যালয়টির মাঠ। যে কোন সময় স্কুলের ভবন গিলে খাবে নদী। তাই ছোট ছোট শিশু শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা তো বসে থাকতে পারেন না। সাবেক-বর্তমান ছাত্র, এলাকাবাসী ও শিক্ষকরা মিলে ভাঙ্গন ঠেকাতে বাঁধ আর বালু ভর্তি বস্তা ফেলছে নদীতে স্কুল রক্ষার জন্য। যদি বাঁচানো যায় স্কুলটিকে।

মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার পদ্মার পাড়ে অবস্থিত কুষ্টিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রায় শতবছরের পুরনো স্কুলটির দুটি ভবন দাঁড়িয়ে আছে সর্বনাশা পদ্মার পাড়ে। তারপরও থেমে নেই স্কুলের পাঠদান। স্কুলের ছোট ছোট শিশুরা ও শিক্ষকরা মিলে ভাঙন ঠেকাতে বাঁধ আর বালু ভর্তি বস্তা ফেলছে নদীতে। স্থানীয়রা জানায়, স্কুল থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দুরে ছিল পদ্মা নদী কিন্তু মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানেই স্কুলটি নদী ভাঙনের মুখে পড়েছে। কর্তৃপক্ষ নদী ভাঙন ঠেকাতে কোন কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় এ বছর হুমকির মুখে পড়েছে স্কুলের ভবন দুটি।

কুষ্টিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. শামিমুর রহমান জানায়, বিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ৪ জন শিক্ষক, ৩ জন শিক্ষিকাসহ প্রায় ১৫০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। পুর্বে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অনেক বেশি থাকলেও নদীর ভাঙনের শিকার হওয়ায় বিদ্যালয় থেকে দিন দিন কমে যাচ্ছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। স্কুলের ভিটে মাটি প্রায় পুরোটাই চলে গেছে, ভবন দুটিও যায় যায় অবস্থা। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন প্রকার সহায়তা না পেয়ে স্থানীয় আরুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের দেওয়া আর্থিক ১০ হাজার টাকা সহায়তায় স্কুলের ভাঙন রোধ করতে সামান্য বাঁধের চেষ্টা করা হচ্ছে। খুদে শিক্ষার্থীদের নিয়েই কোন রকমে বাঁশ আর বালুর বস্তা ফেলে নদী শাসনের কাজ করা হচ্ছে। ওদের দেখাদেখি স্কুলটি রক্ষায় কিছু প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাও এগিয়ে এসেছে সাহায্যের জন্য।

এই বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র মো. আক্কাছুর রহমান বলেন, “আমাদের এলাকার মান্দ্রাখোলা, কুষ্টিয়া, আরোয়া, জগতদিয়া, দক্ষিন সালজানা মিলে ৫টি গ্রামের ছেলে মেয়েরা এই স্কুলে লেখাপড়া করে থাকে। শত বছরের পুরোনো এই স্কুলটি আমাদের চোখের সামনেই আজ নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারছি না। মনের শান্তনা পেতে তাই নিজেরা সামান্য বাধ দেওয়ার চেষ্টা করছি।”

প্রশাসনের পক্ষ থেকে যদি নদী ভাঙন রোধের ব্যবস্থা করা হতো তাহলে শত বছরের ঐতিয্যের স্কুলটি রক্ষা পেত। কুষ্টিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য মো. হাতেম আলী বলেন, “আমরা কয়েক দফা চেষ্টা করেছি স্কুলটিকে রক্ষা করার জন্য কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন প্রকার সাহায্য সহযোগিতা পাচ্ছি না। এক সময়ে আমরা এই স্কুলে পড়েছি আমার ছেলে মেয়েরা পড়াশোনা করেছে এখন আমার নাতি নাতনিরা এই স্কুলে লেখাপড়া করছে। আমাদের পাঁচ গ্রামের মধ্যে এই একটি মাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলটি ভেঙে গেলে আমাদের পাঁচ গ্রামের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আর সহায়তা পেলে স্কুলটি রক্ষা করা সম্ভব, তাই আমি জোর দাবি জানাই স্কুলটি রক্ষার্থে যেন সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন।”

শিবালয়ের আরুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আকতারুজ্জামান খান মাসুম জানান, বিদ্যালয়টি রক্ষার জন্য এখনি যদি পরিকল্পিত ও দীর্ঘস্থায়ী বাঁধ নির্মাণ ও বালির বস্তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা না করা হয়, তাহলে নিশ্চিত বিলীন হয়ে যাবে কুষ্টিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। শিক্ষার হাতেখড়ি থেকে বঞ্চিত হবে মান্দ্রাখোলা, কুষ্টিয়া, আরোয়া, জগৎদিয়া ও দক্ষিন সালজানাসহ কয়েটি গ্রামের ছেলে মেয়েরা।

শিবালয় উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মাইনুল ইসলাম জানান, কুষ্টিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি একদম ভাঙনের মুখে আছে। বিদ্যালয়টি রক্ষার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে বালির বস্তা ফেলার জন্য লেখা হয়েছে। শনিবার পর্যন্ত স্কুলটি রক্ষার জন্য কোন সরকারি বরাদ্ধ পাওয়া যায়নি। স্কুলটি রক্ষার জন্য স্কুলের শিক্ষার্থীরা নিজেরাই বালির বস্তা ভরে ভাঙন স্থানে ফেলছে বলে তিনি জানান।

happy wheels 2

Comments