নারীর চোখে গড়ে তুলি চেতনার বাংলাদেশ
নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
নেত্রকোনা সদর উপজেলার লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের বিরামপুর গ্রামে হাজী ফয়েজ উদ্দিন আকন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ের অবস্থান। নেত্রকোনা- মদন উপজেলার পাকা রাস্তা থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা, যেখানে শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা সকল মৌসুমে শিক্ষার্থীদেরকে প্রচন্ড ধুলা ও কাঁদা মাড়িয়ে অনেক কষ্টে স্কুলে যাতায়াত করতে হয়। স্কুলের পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তরের দূর দূরান্তের প্রায় ১০টি গ্রামের শিক্ষার্থীরা পায়ে হেটে স্কুলে নিয়মিত যাতায়াত করে। কাঁচা রাস্তা হওয়ায় একমাত্র সাইকেল ও মটর সাইকেল ছাড়া অন্য কোন যানবাহন চলেনা। স্কুলের চারদিকের দূরবর্তী ১০টি গ্রামের শিক্ষার্থীরা পায়ে হেটে স্কুলে আসে। পুরুষ শিক্ষার্থীরা সাইকেলে করে স্কুলে আসলেও নারী শিক্ষার্থীরা সামাজিক কারণে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসে না। অথচ আমাদের বাঙালি সমাজে নারীদের সাইকেল ও মটরসাইকেল চালনোর কাজটি স্বাভাবিকভাবে দেখা হলে এবং নারীদেরকে এক্ষেত্রে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে উৎসাহিত করা হলে তারা যোগাযোগের ক্ষেত্রে অনেক ধরণের সমস্যা ও বিড়ম্বনা কাটিয়ে শিক্ষা ক্ষেত্র, পরিবার এবং সকল কর্মক্ষেত্রে সঠিক সময়ে আরও অধিক কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হবে।
আমাদের সমাজ দেশের অনেক সচেতন লোক আছেন যারা এমন একটি সমাজের স্বপ্ন দেখে থাকেন, যেখানে নারীর মর্যাদা, কাজের স্বীকৃতি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, নারীর নিরাপত্তা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অধিকারের জন্য মিটিং মিছিলের প্রয়োজন হবে না। যেখানে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সকল ক্ষেত্রে নারীদের নারী হিসেবে নয়, একজন মানুষ হিসেবে পরিচিত হবে। যে সমাজে শুধু পুত্র সন্তানের আশায় নারীরা অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও বছরের পর বছর সন্তান নিতে বাধ্য হবে না, মেয়ে সন্তান জন্ম হওয়ায় পরিবারের একটা বোঝা বাড়ল এমন ভাবনা কোন অভিভাবকের মাথায় আসবে না, ছেলে ও মেয়ে সন্তান উভয়েই পরিবার ও সমাজে বরণীয় হবে। এমন একটি স্থিতিশীল, পারস্পারিক সহনশীল, শান্তিপূর্ণ ও সকল শ্রেণীর মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এক বহুত্ববাদী সমাজ গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, পরিবেশগত, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কে সচেতন নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলা। এমনই স্বপ্ন নিয়ে নিজের অবস্থান থেকে নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন নেত্রকোনা সদর উপজেলার লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের বিরামপুর গ্রামের ‘হাজী ফয়েজ উদ্দিন আকন্দ উচ্চ বিদ্যালয়’র প্রধান শিক্ষক আজহারুল ইসলাম তুহিন।
শিক্ষক আজহারুল ইসলাম তুহিন বহুত্ববাদী সমাজ ব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যে পুরুষের সাথে সমান মর্যাদায় নারীকে সমানভাবে পথ চলার একজন কারিগর হিসেবে নিজের অবস্থান থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। পরিবারের কন্যা শিশুকে বোঝা হিসেবে না দেখা, কন্যা সন্তান কোন ধরণের বিপদে কাজে আসবে না বা কন্যা সন্তানের নিজের স্বাধীন চিন্তার ক্ষমতা নেই, একাকী পথ চলার সক্ষমতা নেই, অভিভাবকদের এ ধরণে চিন্তার পরিবর্তন করতে তিনি নানামূখী ভূমিকা পালন করেন। তারই ধারাহিকতায় অনেক দূর থেকে (৪-৫ কিলোমিটার) স্কুলে আসা যাওয়ার নিরাপত্তাহীনতায় স্কুল থেকে ঝরেপড়া বন্ধে ও নারী শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে বারসিক’র সহযোগিতায় তিনি আয়োজন করেন পরিবেশবান্ধব নিরাপদ দ্রুতযান সাইকেল চালানো। যার নাম দিয়েছেন “নারীর চোখে গড়ে তুলি চেতনার বাংলাদেশ”। এই শ্লোগানকে সামনে রেখে ১৫ জন নারী শিক্ষার্থী ধীরগতির সাইকেল চালানো প্রতিযোগিতার অংশগ্রহণ করেন। মূল প্রতিযোগিতা শেষে অংশগ্রহণকারী নারী শিক্ষার্থীরা দ্রুতগতিতে মাঠে সাইকেল চালিয়ে উল্লাস প্রকাশ করে।
প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকারী দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী মুক্তা আক্তার অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, “প্রায় এক সহস্রাধিক শিক্ষার্থীদের সামনে ধীর গতির সাইকেল চালনা প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে আমার খুব ভালো লেগেছে। আমার সাহস এখন আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। এখন থেকে আমি সাইকেলে স্কুলে যাতায়াত করবো।” বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আজহারুল ইসলাম তুহিন বলেন, “আগামী বছর আমি কমপক্ষে ২০০ জন নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে সাইকেল রেসের আয়োজন করবো, যাতে তারা সংকোচমুক্ত হয়ে সাহসের সাথে সামনে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়, সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে পারে, সেই মানসিকতা ও সক্ষমতা তাদের মধ্যে গড়ে তুলব।”
উল্লেখ্য যে, বিভিন্ন বিষয়ে বই পড়ায় শিক্ষার্থী ও যুব সমাজকে আগ্রহী করে তুলতে বারসিক গ্রাম পর্যায়ে জন উদ্যোগে পাঠাগার গড়ে তুলতে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে আসছে এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রচারণা চালিয়ে আসছে। তারই অংশ হিসেবে বারসিক’র উদ্যেগে প্রতিযোগিতায় বিজয়ী শিক্ষার্থীদেরকে পুরষ্কার হিসেবে নেত্রকোনা অঞ্চলের বিভিন্ন লেখকদের লেখা বই উপহার প্রদান করা হয়। শিক্ষার্থীরা নেত্রকোনা অঞ্চলের লেখক ও নেত্রকোনা অঞ্চলের উপর তাদের লেখা বই পেয়ে খুবই উৎফুল্ল ।