জলবায়ু পরিবর্তন: অভিযোজনে কৃষকের উদ্যোগ ও অভিজ্ঞতা

সিংগাইর মানিকগঞ্জ থেকে শাহীনুর রহমান

হাজার বছর ধরে বাংলাদেশর গ্রামীণ জনগোষ্ঠি বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টির মত নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে সহবস্থানের মধ্য দিয়ে নিজদের স্থানীয় ও লোকায়ত জ্ঞান চর্চার মাধ্যমেই কৃষিতে জলবায়ুবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলা করে থাকেন। এলাকার সাথে খাপখাইয়ে চাষ করেন এলাকা উপযোগী ফসল নিজেদের মত করে তৈরি করেন ফসল পঞ্জিকা। বৈচিত্র্যময় ফসলের জাত বাছাই ও পরিক্ষা করে তৈরি করেন নিজেদের পছন্দের জাত। আর সুদীর্ঘকালের কৃষকের এই পরীক্ষা ও অভিজ্ঞতা থেকে কৃষিতে যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের হাত থেকে কৃষিকে টিকিয়ে রাখতে গ্রহন করেন নানা উদ্যোগ।

কৃষকের এই অভিজ্ঞতা ও উদ্যোগকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করে বারসিক। বারসিক বিশ্বাস করে প্রাকৃতিক নিয়মে সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন রোধ না করা গেলেও কৃষকের নানামুখী অভিজ্ঞতা উদ্যোগ, স্থানীয় ও লোকায়ত চর্চার মাধ্যমেই জলবায়ু পরিবর্তনে মানবসৃষ্ট কারণগুলো নিয়ন্ত্রণ করে কৃষি উপযোগি পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব। তাই তাদের এই উদ্যাগকে আরো গতিশীল করার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন ও প্রশমনে জনগোষ্ঠীর দক্ষতা উন্নয়নে মানিকগঞ্জের বিভন্ন গ্রামে গ্রামভিত্তিক কৃষক সংগঠন,যুব সংগঠন,সাংষ্কৃতিক দল,পেশাভিত্তিক সংগঠন,নারী সংগঠন,সাংবাদিক শিক্ষক, কিশোর কিশোরীদের সাথে মাসিক সভা, উঠান, বৈঠক, জৈব সার, জৈববালাই নাশক, জৈব মডেল ফার্ম, বীজবাড়ী তৈরি, বীজ সংরক্ষণ, বীজ বিনিময়, বসতবাড়ী বাগান, স্থানীয় জাতের বৈচিত্র্যময় ফসল চাষ, ফলজ, বনজ ওষুধি, তাল, খেজুর বীজ রোপণ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি নিরসনে জলবায়ু সহনশীল ফসলের জাত উন্নয়ন ও প্রচারণামূলক বিলবোর্ড স্থাপন করে দিয়ে নিয়মিত সহায়তা করে আসছে।

এ ধরনের উদ্যোগের সাথে নিজেদের যুক্ত করেছেন সিংগাইর উপজেলার বলধারা, বায়রা ইউনিয়নের আব্দুর রহমান, সন্তোষ মন্ডল, আব্দুল লতিফ, সাহাবউদ্দিন মিয়া, ছকিল উদ্দিন, তমিজউদ্দিন মিয়া, ভানু রায়, আব্দলু খালেক, মহাদেব মন্ডল, নয়াবাড়ির ইব্রাহিম মিয়া, ঈমান আলী, কমলা বেগম, রোকেয়া বেগমদের মত প্রবীণ কৃষক কৃষাণি। তারা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় নিজেদের কিছু উদ্যোগ অভিজ্ঞতা ও করণীয় সম্পর্কে কথা বলেন বারসিক নিউজ.কমের সাথে।

তারা বলেন, যখন বৃষ্টি হওয়ার কথা তখন হয় না । যখন বর্ষা হওয়ার কথা তখন বর্ষা হয় না। আমরা দেখছি জৈষ্ঠের মাঝা মাঝিতে বৃষ্টি শুরু হইতো না হইলে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বৃষ্টি হয়। কিন্তু এখন আমরা দেখেছি চৈত্র মাসের বৃষ্টি আষাঢ় মাসের মত হয়। কৃষি জমিতে বর্ষার পানি যেত জৈ্যষ্ঠ  আষাঢ় মাসে আসতো। ঠান্ডা, গরমের সাথে মৌসুম অনুযায়ী শীতকালিন ও চৈতালি ফসল খেসারি, মুসুরি, তিল, পাট কাউন, ছোলা, মটর, ডাবরি, কালি মটর, আউশ আমন এক সাথে চাষ করতাম, পানির মধ্য আমন ধান রাইখা আউশ ধান কাটতাম, পানি বাড়তো আমন ধান ও পানির সাথে সাথে বাড়তো। এখন সময় মত পানি হয় না আগের মত আমন ধানও হয় না। আগে বৃষ্টি হতো সময় মত বন্যাও হতো সময় মত। বৃষ্টি বন্যার পানিতে কৃষি জমিতে পলি পড়তো ফসল ভালো হতো, জমিতে সার বিষ দেওয়া লাগতো না।’

তারা আরো জানান, অতিমাত্রায় কালোধোয়া, কৃষি জমিতে গড়ে উঠা, মিল কারখানা, ইটের ভাটা, অপিরকল্পিতভাবে ঘরবাড়ি নির্মাণ, বৃক্ষ নিধন, কৃষি জমিতে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার, বিষ ব্যবহার নদী নালা, খাল বিল দখল ও ভরাট করার ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হয়েছে যার প্রভাব পড়ছে কৃষিতে। আগে ব্যাঙ ডাকতো মানুষ ধরে নিত বর্ষা হবে, আম বেশি হলে ধান বেশি হবে। কিন্তু নানা কারণে পরিবেশ নষ্ট হওয়ায় এই ধারণা এখন আর মানুষ করতে পারে না। তাই কৃষকদের অভিজ্ঞতা দিয়েই বাৎসরিক কৃষি কাজের প্রস্তুতি নিতে হয়। আমরা এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলা করতে নিজেরা বীজ রাখি, বীজ কৃষক কৃষক বিনিময় করি, মাটির হাড়ি, পলিথিন, বাড়ির উঠানে কচুরিপানা দিয়ে ধান, দেশী, লাউ, সীম ওস্তা, ফুলকপি, বাধাকপি বীজতলা করে চারা তৈরি করি, জমি থেকে পানি নেমে গেলে রোপণ করি। মাটির পানি ধরে রাখা ও উর্বরতা এভাবে আমরা বন্যা, বর্ষার ঝুঁকি মোকাবেলা করি। তাছাড়া ঠাটা, বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে তাল, খেজুর দেবদারুসহ ফলজ, বনজ,ওষুধি গাছ রোপণ করি।

তারা মনে করেন, জলবায়ুর পরিবর্তন মানব কল্যাণ, কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্য, জীববৈচিত্র্য ও জনগোষ্ঠির টেকসই জীবনযাত্রা এবং খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য একটি বড় হুমকি। এ বিরূপ পরিস্থিতির সাথে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার সামঞ্জস্য বিধান করে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে কৃষিকে নিরাপদ রাখা বা ঝুঁকি কমানো, দূর্যোগমুক্ত সময়ে শস্য বহুমূখীকরণ করতে হবে। এ রকম পরিস্থিতিতে দেশের খাদ্য ও কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন ও দূর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস বাস্তবায়ন করতে হলে লোকায়ত জ্ঞান এর পাশাপাশি বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য উপাত্তের ব্যবহার করে উপযোগি কলা কৌশল পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা জরুরি।

happy wheels 2

Comments