ভিক্ষা না করে ফেরি করেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সাহাজান সেলিম

ভিক্ষা না করে ফেরি করেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সাহাজান সেলিম

সাতক্ষীরা থেকে বাহলুল করিম

কখনো সদর হাসপাতাল গেটে, কখনোবা আদালতের সামনে, আবার কখনো এসপি অফিসের সামনে, কখনোবা রাস্তায় হেঁটে, এভাবে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি প্রতিদিন জাতীয় পতাকা, ক্যালেন্ডার, দাঁত মাজা ব্রাশ, হাত পাখা, বাচ্চাদের খেলনা, ঝাড়ু, বাড়ুনসহ বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করে সংসার চালান সাতক্ষীরার দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সাহাজান সেলিম। অন্যান্যদের মতো ভিক্ষা না করে সাবলম্বী হয়েছেন নিজেই।

সাহাজান সেলিম ১৯৭৩ সালের ১৮ মার্চ অন্ধ হয়েই দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সদর উপজেলার পুরাতন সাতক্ষীরার ঘোষপাড়া সংলগ্ন মদিনা মসজিদের পাশেই বাড়ি তার। বাবা জামাত আলী সরদার ও মা নুরজাহান। পরিবারের সদস্য ১২জন। বাবা, মা, তিন ভাই এবং ভাবি ও তাদের সন্তান নিয়েই তার সংসার। পরিবারের বড় ছেলে সে। একটি সাদা ছড়ির সাহায্যে চলাচল করেন তিনি।

Phygicaly Challenged Selim 1

যেহেতু তিনি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী তাই ছোটবেলা থেকে পড়ালেখার তেমন সুযোগ পাননি। সম্ভবত সাত বছর বয়সে ভর্তি হয়েছিলেন বাঁকাল অন্ধ স্কুলে। সপ্তাহে একদিন স্কুলে যেতেন। বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে সঙ্গীতা মোড়ে আসতেন। তারপর বাসে করে গিয়ে নামতেন স্কুলের সামনে।

আর বাকি ছয়দিন বাসে বাসে গিয়ে মানুষের কাছে সাহায্য চাইতেন। এতো ছোট বয়সে কী করবে সে? দারিদ্রতার কারণে এক প্রকার বাধ্য হয়েই এই কাজ করতেন তিনি।

বাকাল অন্ধ স্কুলের শিক্ষক মজিদ সাহেবের বাসায় গিয়ে রাতে ক্লাস করতেন তিনি। তবে পরীক্ষার ফলাফল ছিল ভালো। অন্ধ স্কুলের অন্যান্য ছাত্রদের মধ্যে তিনি ছিলেন অনেক মেধাবী। এভাবে অষ্টম শ্রেণি পাশ করেন। নানা প্রতিকূলতার মাঝে আর পড়ার সুযোগ হয়নি তার। এখানেই শিক্ষাজীবনের ইতি টানতে হয় তাকে।

সাহাজান সেলিম ১৯৮৮ সালে সাতক্ষীরা অন্ধ কল্যাণ সমিতি থেকে পাঁচশ টাকা ঋণ নিয়ে এই ফেরি করার কাজ শুরু করেন। প্রথমে তিনি ফেরি করে ঝাড়ু ও বাড়ুন বিক্রি করতেন শহরের বিভিন্ন জায়গায়। পরবর্তীতে হাত পাখা বিক্রি করতেন বাসে বাসে।

প্রতি বছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে সাতক্ষীরা জর্জ কোর্ট ও ভূমি রেজিস্ট্রার অফিসের সামনে সরকারি ছুটি সম্বলিত ক্যালেন্ডার বিক্রি করেন।

বর্তমানে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের গেটের সামনে ফেরি করে জাতীয় পতাকা, হাত পাখা, দাঁত মাজা ব্রাশ, বাচ্চাদের খেলনা বিক্রি করেন। তিনি এসব জিনিস সাতক্ষীরার বড়বাজার থেকে কিনে আনেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে তিনি এসব জিনিস বিক্রি করেন। প্রতিদিন ৮০-১০০ টাকার মতো আয় হয়। তা দিয়েই চলে তার সংসার। আবার অনেকে স্বেচ্ছায় টাকা দেয় ভালোভাবে ব্যবসা করার জন্য।

Phygicaly Challenged Selim 2

ফেরি করে জিনিস বিক্রি করেন সাহাজান সেলিম। প্রায়ই বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তাকে। ২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর রাস্তায় চলার পথে একটি গরু তাকে ধাক্কা দেয়। এতে পড়ে গিয়ে তার ডান পা ভেঙে যায়। তখন থেকে তিনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। হাসপাতাল থেকে অনেকবার হেয় প্রতিপন্নও হয়েছেন তিনি। তবুও জীবিকার জন্য এখনো আসেন সদর হাসপাতাল গেটে ফেরি করে জিনিস বিক্রি করার জন্য।

এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় মাসুম বিল্লাহ পলাশ বলেন, “আমার চাকরি জীবনে আমি এরকম লোক খুব কমই দেখেছি। শহরের অন্যান্য অন্ধরা ভিক্ষা করে। কিন্তু সেলিম ভাই ভিক্ষা করেন না। শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে নানা ধরণের জিনিস বিক্রি করেন। সবাই তার কাছ থেকে জিনিস কেনে। তিনি সদর হাসপাতালের গেটে বহুদিন ধরে এসব জিনিস বিক্রি করছেন।”

সদর উপজেলার মাছখোলা গ্রামের বাসিন্দা ও সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের মাস্টার্সের ছাত্র আব্দুল কাদের বলেন, “আমি ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি উনি (সেলিম) অন্ধ হয়েও ফেরি করে জিনিস বিক্রি করেন। কারো কাছে টাকা চান না। শহরে চলার পথে বিভিন্ন জায়গায় উনাকে দেখি। আমি মাঝেমাঝে উনার কাছ থেকে ক্যালেন্ডারও কিনি।”

Phygicaly Challenged Selim 3

একান্ত আলাপকালে সাহাজান সেলিম বলেন, “এক সময় আমার বাবা আমার মা’কে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। তখন আমি খুব ছোট। আমি মায়ের সাথে চলে আসি। আমার মা প্রথমে রাইচ মিলে কাজ করতো। এভাবে কোনমতে চলতো আমাদের সংসার। স্কুলে ভর্তি করার জন্য একজন ব্যাংক কর্মীর সহযোগিতায় আমাকে পাঠানো হয় সদরের সুলতানপুর এলাকার অন্ধ আবুল কালাম আজাদের বাড়ি। পথে যেতে যেতে খুঁজে পেলাম একজন শিক্ষকের বাসা। এটা ছিল আমি যে স্কুলে ভর্তি হবো, সে স্কুলের শিক্ষক মজিদ স্যারের বাসা। স্যার মা’কে বললেন আপনার ছেলেকে নিয়ে আগামীকাল স্কুলে আসেন। পরদিন মায়ের সাথে স্কুলে যাই এবং স্যার আমাকে স্কুলে ভর্তি করে নিলেন। তবে দরিদ্রতার কারণে বেশিদূর লেখাপড়া করতে পারিনি। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছি। তারপর পড়া বন্ধ হয়ে যাই। ১৯৮৮ সাল থেকেই আমি ফেরি করে এসব জিনিস বিক্রি করি।”

তিনি আরও বলেন, “সাতক্ষীরা জেলাতে আমার মতো ৬৪’শ অন্ধ মানুষ আছে। অনেকেই অন্ধ কল্যাণ সমিতি থেকে ঋণ নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। কিন্তু তারা ঠিকমতো ঋণের টাকা পরিশোধ করে না। কিছুদিন ব্যবসা করার পর বন্ধ করে দেয়। আবার ভিক্ষা করে। কিন্তু আমি ভিক্ষা না করে ফেরি করে জিনিস বিক্রি করি। এতে যা আয় হয় আমার সংসার চলে যায়। বর্তমানে আমি সাতক্ষীরা অন্ধ কল্যাণ সমীতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। আমার মতো কাজ করে সংসার চালানো সম্ভব। এজন্য বলছি আপনারা কেউ ভিক্ষা করবেন না। কাজ করে টাকা উপার্জন করুন। তাতে আল্লাহও খুশি হবেন, সুখে থাকবেন সবাই।”

ভিক্ষাবৃত্তি সমাজের জন্য একটি অভিশাপ। প্রতিবন্ধী হয়েও সেলিমের মতো কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করা সম্ভব। সেলিমের কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত সমাজের অন্যান্য ভিক্ষুকদের।

happy wheels 2

Comments