দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসকল্পে হাওরাঞ্চলে জনগোষ্ঠী বিভিন্ন ধরণে উদ্যোগ গ্রহণের অঙ্গিকার

নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং

গত ১৭ থেকে ২০ আগস্ট ২০২০ বারসিক মদন রির্সোস সেন্টার’র আয়োজনে এবং মদন উপজেলার মদন ও গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের কৃষক-কৃষাণী, যুব, ও শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশার জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে “জলবায়ু পরিবর্তন, দূর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস ও জন ব্যবস্থাপনা” শীর্ষক দিনব্যাপী চারটি রিফ্রের্সাস প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। দু’টি প্রশিক্ষণ মদন ইউনিয়ন (কুলিয়াটি) পরিষদ হল রুমে এবং দু’টি প্রশিক্ষণ গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের গোবিন্দশ্রী উচ্চ বিদ্যালয় হল রুমে অনুষ্ঠিত হয়। চারটি রিফ্রের্সাস প্রশিক্ষণে দু’টি ইউনিয়নের চারটি গ্রামের (উচিতপুর, কুলিয়াটি, দক্ষিণ মদন ও গোবিন্দশ্রী) ১০৫ জন অংশগ্রহণ করে। বারসিক নেত্রকোনা অঞ্চলের পরিচালক সৈয়দ আলী বিশ্বাস প্রশিক্ষণগুলো সঞ্চালনা করেন। প্রশিক্ষণ সঞ্চালনায় সহযোগিতা করেন বারসিকের শংকর ¤্রং, অহিদুর রহমান ও সুমন তালুকদার।
১৭ ও ১৮ আগস্ট মদন ইউনিয়ন পরিষদ হল রুমে এবং ১৯ ও ২০ আগস্ট হাওর অধ্যুষিত গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের গোবিন্দশ্রী উচ্চ বিদ্যালয়ের হল রুমে প্রশিক্ষণগুলো অনুষ্ঠিত হয়। প্রশিক্ষণে মদন ইউনিয়নের ৫৪ জন এবং গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের ৫১ জন অংশগ্রহণ করেন। দিনব্যাপী চারটি প্রশিক্ষণের মধ্যে দু’টি প্রশিক্ষণ কৃষক ও অন্যান্য পেশার জনগোষ্ঠী এবং দু’টি প্রশিক্ষণ যুবদের জন্য আয়োজন করা হয়।


প্রশিক্ষণের ফলে দু’টি ইউনিয়নের ১০৫ জন অংশগ্রহণকারী (যুব-৫৩ জন) হাওরাঞ্চলের সংঘটিত বিভিন্ন দূর্যোগের বর্ণনা করেন। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীরা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সৃষ্ট এবং প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগগুলো সম্পর্কে ধারণা লাভ করে। অংশগ্রহণকারীরা হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে প্রধানতম হিসেবে- আগাম বন্যা, আফাল (ঢেউ), অতিবৃষ্টি, খরা, ফসলের রোগ-বালাই, খাবার/গোসলের পানির সমস্যা, অনুন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, বসতভিটা ও রাস্তা ভাঙন ইত্যাদি তুলে ধরেন। এছাড়াও সঞ্চালকের আলোচনা থেকে অংশগ্রহণকারীরা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও জলবায়ু জনিত বিভিন্ন দুর্যোগ (ফসলের রোগ-বালাইয়ের প্রার্দুভাব, কোল্ড ইঞ্জুরী, খরা, অতিবৃষ্টি ইত্যাদি), প্রাকৃতিক দুর্যোগ (আগাম বন্যা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস, ভূমিকম্প, সুনামি, শিলাবৃষ্টি,ইত্যাদি) ও মানবসৃষ্ট কারণে (বৃক্ষ নিধন, শিল্পায়ন, পলিথিনের ব্যবহার বৃদ্ধি, বিলাসী জীবনযাপন, নগরায়ন, অতিমাত্রায় প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন, কৃষি ক্ষেত্রে রাসায়নিক দ্রব্যের অতিমাত্রায় ব্যবহার, ইঞ্জিন চালিত নৌকা ইত্যাদি) হাওরাঞ্চলে ঘটে যাওয়া দুর্যোগগুলো (রাস্তা ভাঙ্গন, বসতভিটা ভাঙন, বজ্রপাতের সংখ্যা বৃদ্ধি, ফসলের রোগ-বালাই বৃদ্ধি, খরা ইত্যাদি) সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করে।


অংশগ্রহণকারীরা দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে হাওরাঞ্চলের জনগোষ্ঠীর স্থানীয় অভিযোজনের কৌশলগুলো পরস্পরের সাথে সহভাগিতা করেন। হাওরের জনগোষ্ঠী দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসের জন্য যেসব স্থানীয় চর্চাগুলো করে থাকেন তারমধ্যে- উজাউড়ি, মূর্ত্যা, নলখাগড়া, হিজল, করচ ইত্যাদি পানি সহনশীল জাতের গাছ রাস্তার ধারে, বসতভিটার চারপাশে, বিভিন্ন স্থাপনার ধারে রোপণ এবং জার্মুনী পানা বসতভিটার চারপাশে (ঢেউয়ের মুখে) জমিয়ে রাখেন। আগাম বন্যা, কোল্ড ইঞ্জুরি ও রোগবালাই থেকে ফসল রক্ষায় আগাম ধানের জাত রোপণ করেন এবং কেউ কেউ ধানের পরিবর্তে অন্যান্য ফসল যেমন-সরিষা, গোল আলু, খিরা, মরিচ, বাদাম, মাসকলাই, ভূট্টা ইত্যাদি চাষ করেন।


অংশগ্রহণকারীরা দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে জনগোষ্ঠীর করণীয় সম্পর্কে জানতে পেরে নিজ নিজ অবস্থান থেকে নি¤েœাক্ত উদ্যোগ নেয়ার অঙ্গিকার করে। যেমন-আগাম একাধিক ধানের জাত চাষ, বৈচিত্র্যময় শস্য ফসল চাষ বৃদ্ধি, কৃষি জমি অন্য কাজে ব্যবহার না করা, পানি সহনশীল গাছের বনায়ন, বজ্রপাত রোধে হাওরে তাল/উঁচু জাতীয় গাছের চারা রোপন, নদী/খাল ভরাট না করা, হাওরের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, সুষম মাত্রায় রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে পরিবেশ/পানি দূষণ রোধ, ভূ-গর্ভস্থ পানির কম ব্যবহার, কম ধোয়া ও জ্বালানি সাশ্রয়ী চুলা ব্যবহার করা। এছাড়াও সেচ ও গোসলের জন্য বৃষ্টির পানি পুকুর/খাল/ডোবায় সংরক্ষণ, হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধে সামাজিক বনায়ন, ভূমির ক্ষয় রোধ ও উর্বরতা রক্ষায় জৈব উপায়ে চাষাবাদ করা, বসতভিটার পতিত জায়গায় তাল জাতীয় গাছ রোপণ করা এবং দুর্যোগের আগে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে এলাকায় প্রচারণা করা এবং দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ পরবর্তী কার্যক্রমে পরস্পরকে সহযোগিতা করার অঙ্গীকার করে।
যেসব কাজ জনগোষ্ঠীর পক্ষ্যে করা সম্ভব নয় সেসব কাজের জন্য স্থানীয় সরকারের (ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, উপজেলা প্রশাসন) সাথে যোগাযোগ করে তাদেরকে প্রভাবিত করার অঙ্গীকার করেন। মোট কথায় অংশগ্রহণকারীরা প্রশিক্ষণ থেকে লব্ধ জ্ঞান ও জনগোষ্ঠীর লোকায়ত জ্ঞানের সমন্বয়ে হাওরাঞ্চলে সংঘটিত দুর্যোগ মোকাবেলায় অনেকটা সক্ষম হবে বলে আশা প্রকাশ করেন। অংশগ্রহণকারীরা পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে ঢেউ থেকে বসতভিটা রক্ষায় ভিটার চারপাশে সামর্থ অনুযায়ী পানি সহনশীল গাছের আচ্ছাদন তৈরির অঙ্গীকার করেন।


প্রশিক্ষণ শেষে অংশগ্রহণকারীরা প্রশিক্ষণের ফলে দুর্যোগের বিভিন্ন কারণ সম্পর্কে এবং দুর্যোগ মোকাবেলায় ব্যক্তি, জনগোষ্ঠীর সমন্বিত উদ্যোগ ও স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব সম্পর্কে জানার ফলে হাওরের দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে তারা অবদান রাখতে পারবেন বলে মত প্রকাশ করেন।

happy wheels 2

Comments