সূর্যই শক্তি, ধনী-দরিদ্রের জ্বালানিবন্ধু

::মো. এরশাদ আলী,গবেষক ও লেখক::

কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার একটি চর চরকালুয়া। এই চরেই বসবাস করে হাসি। সে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়াশুনা করে। চরকালুয়ার হাঁসি বইতে পড়েছে, সূর্যের আলো দিয়ে গাছ খাদ্য ও শক্তি তৈরি করে। গত একবছর ধরে হাসি শুধু দিন নয়, রাতেও সূর্যের আলোতে তার লেখাপড়া চালাতে পারছে।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে জ্বালানি ও শক্তির উপযোগিতার কথা বলে শেষ করার মত নয়। শ্বাস-প্রশ্বাস এর মতোই দরকারি ও প্রয়োজনীয় এই জ্বালানি। বাড়তি জনসংখ্যার জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার সরঞ্জামাদি যোগানের জন্য বাড়ছে শিল্প, যানবাহন, আর সেই সাথে বেড়ে চলেছে জ্বালানি ও শক্তির ব্যবহার। ২০০৯ সাল থেকে এটি স্পষ্টত প্রতীয়মান যে, সহজলভ্যতার কারণে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন পদ্ধতি মূলত একক-জ্বালানির উপর নির্ভরশীল। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অংশভাগ মাত্র ০.৫%। সৌর বিদ্যুতের জন্য বাংলাদেশ খুবই সম্ভাবনাময় একটি দেশ। কারণ এখানে বছরের বেশিরভাগ দিনই রোদ থাকে। বাংলাদেশে সৌর বিদ্যুৎ সম্ভাবনাকে বাস্তব করতে ২০০৩ সাল থেকে বিভিন্ন কোম্পানি কাজ করে এসেছে। সোলার হোম সিস্টেম মূলত গ্রামে বসবাসকারী পরিবারগুলো এবং গ্রাম বা শহরের মধ্যবিত্ত পরিবার বেশি ব্যবহার করে থাকে; বিশেষ করে যে সব এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। বসতবাড়িতে সোলার হোম সিস্টেম ব্যবহার করে এমন পরিবারগুলোর সবাই কোন না কোনভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ গ্রহণকারী এবং তারা পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ ব্যবহারের পাশাপাশি সোলার হোম সিস্টেম ব্যবহার করছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগ গ্রাহকই মূলত তিনটি কারণে সোলার হোম সিস্টেম ব্যবহার করেন, পল্লী বিদ্যুতের অতিরিক্ত লোডশেডিং, বাচ্চাদের লেখাপড়া ঠিকমত চালানো এবং আলো জ্বালানো বাবদ অতিরিক্ত খরচ থেকে বাঁচা। বর্তমানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একাংশ সৌর বিদ্যুতের সুবিধা পাওয়ার আশায় ক্ষুদ্র ঋণ সরবারহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিচ্ছে। মূলত সিস্টেম ক্রয়ের পূর্বে ডাউনপেমেন্ট পরিশোধ করার জন্য এরকম ঋণ গ্রহণ করছে। একদিকে ডাউনপেমেন্টের জন্য গ্রহণকৃত ঋণের কিস্তি অন্যদিকে সিস্টেম ক্রয়ের কিস্তি দুটো পরিশোধ করতে গিয়ে পরিবারগুলোকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অনেক সময় সঠিক সময়ে কিস্তি পরিশোধ করতে না পারায় মানসিক অশান্তিতে দিন কাটাচ্ছে। ১৫ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে পরিবারগুলো সোলার সিস্টেম নেওয়ার পর কোন সমস্যা দেখা দিলে বা কোন সমস্যা না হলেও বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে কিস্তি দিতে চায় না। ফলে কিস্তি সংগ্রহকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সাথে এক ধরনের দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে। ফলাফলস্বরূপ গ্রাহক ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সামাজিক মর্যাদা বা ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তি এবং গ্রাহকরা একজন আরেকজনকে সহ্য করতে পারছে না। যদিও বলা হচ্ছে এটি একটি সামাজিক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান তবে বাস্তবে সম্পূর্ণ উল্টোটা ঘটছে, সেবামূলক না হয়ে প্রতিহিংসার রূপ ধারণ করছে প্রতিনিয়ত।

সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক’র একটি গবেষণায় সোলার হোম সিস্টেম বিষয়ক বেশ কিছু সমস্যা এবং এর পাশাপাশি কিছু সমাধানও উঠে আসে। গবেষিত অঞ্চলের মানুষের মতে, যেসব সমস্যা দেখা যায় তা হলো: খারাপ আবহাওয়ার সময় পুরো সিস্টেম অচল হয়ে পড়ে। অপচয় না করে পরিমিত ব্যবহার করলে এ সমস্যার কিছুটা সমাধান করা সম্ভব। গবেষিত অঞ্চল গাইবান্ধার তথ্যদাতাদের মধ্যে অনেকেই বলেন যে, সব ঘরে সোলার প্যানেল বসানো আছে সেখানে বেশি বজ্রপাত হয় যদিও অন্যান্য তথ্যদাতারা এই আশংকা ভুল বলে স্বীকার করেন। দূর্বল সংযোগের ফলে লাইটে সমস্যা দেখা দেয়। চার্জ কন্ট্রোলার অতিদ্রুত নষ্ট হয়ে যায় এবং আলো কম হয়। বেশিরভাগ সমস্যাই মূলত গ্রাহকদের সচেতনতার অভাবেই হয়ে থাকে। ব্যাটারির ডিস্টেল পানি শেষ হয়ে গেলে তা বদলিয়ে দিতে হবে। ওয়ারেন্টির নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যাবার পরে যন্ত্রাংশ ক্রয় করতে ব্যবহারকারীকে বেগ পোহাতে হয়। সোলার হোম সিস্টেমের কোন কিছু নষ্ট হলে সরবারহকৃত প্রতিষ্ঠান ছাড়া এটি মেরামতের জন্য আশেপাশে কোন টেকনিশিয়ান পাওয়া যায় না।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চলেই ভোকেশনাল বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় রয়েছে। পর্যাপ্ত কারিগরি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই সব বিদ্যালয়ে সোলার হোম সিস্টেম বিষয়ে ট্রেড কোর্স চালু করা যেতে পারে। বর্তমানে যে ব্যাটারি দেওয়া হয় তার পাত কম এবং বর্তমানে যে সব ক্যাবল দেওয়া হচ্ছে তা চিকন হওয়ায় ভোল্টেজ কম পায়। এছাড়া বর্তমানে গ্রাহকদের যে প্যানেল দেওয়া হচ্ছে তা বাংলাদেশ অথবা চীনের তৈরি যা খুব বেশি টেকসই হয় না। টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের অবস্থান সীমান্তবর্তী হওয়ায় এই এলাকা দিয়ে চোরাচালান নিত্য নৈমেত্তিক ঘটনা। কোন পরিবার সোলার ব্যবহার করতে চাইলেও চোরাকারবারীদের কারণে তারা ব্যবহার করতে পারে না। রাতে এলাকার ঘরে ঘরে আলো জ্বললে চোরাকারবারীদের চোরাচালান করতে সমস্যা হয়। আবার কেউ যদি বাড়িতে সোলার ক্রয় বা কোন উন্নয়নমূলক কাজ করে তবে সামাজিকভাবে সবাই মনে করে পরিবারটি ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িত। এটি একটি বড় সমস্যা। গবেষিত অঞ্চল গোয়াইনঘাট এর তথ্যদাতারা জানান, ভৌগলিকভাবেই এই অঞ্চল অধিক বৃষ্টির এলাকা। একবার বৃষ্টি শুরু হলে একটানা ৫ থেকে ৬ দিন বৃষ্টি হয়। বৃষ্টির এই সময়গুলোতে রোদ না থাকার ফলে তাদের অন্ধকারে থাকতে হয়। বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায় কিস্তি পরিশোধ যখন শেষ হয়ে যায় ঠিক ওই সময়গুলোতেই পুরো সিস্টেমের আর কার্যক্ষমতা থাকে না। তাছাড়া কিস্তিতে সোলার নেওয়া মানে মাকড়সার জালে নিজেকে আটকানো। তবে এই ব্যবস্থায় ক্রয় করলে কিস্তি পরিশোধ হওয়া পর্যন্ত যেকোন সময় সার্ভিস পাওয়া যায় ফলে অন্ধকারে থাকতে হয় না।

সৌর বিদ্যুৎ মানেই নিজস্ব বিদ্যুৎ। যখন প্রয়োজন তখনই ব্যবহার করা যায়। যারা কিস্তিতে নিয়েছে কিস্তি পরিশোধ হয়ে গেলেই সিস্টেমের মালিক নিজেই। সুতরাং এই ব্যবস্থা অবশ্যই ভালো। গবেষিত অঞ্চলের তথ্যদাতারা বেশ কিছু সুবিধার বিষয়ে উল্লেখ করেন : টেকনাফ উপজেলার একজন তথ্যদাতা রুহুল আমিন বলেন, “একজন ব্যক্তি যখন কিস্তিতে সোলার ক্রয় করে, তখন এক থেকে তিন বছরের মধ্যে সেই সোলারটা নিজের হয়ে যায়। এরপর আর তাকে কোন মাসিক বিল দিতে হয় না। অর্থ্যাৎ সারাবছর কিছু রক্ষণাবেক্ষণ খরচ ছাড়া আর কোন খরচ তাদেরকে করতে হয় না।” একই উপজেলার আলম বলেন, “সোলার ব্যবহারের পূর্বে তার বাড়িতে প্রতিমাসে যে বিদ্যুৎ বিল আসতো সোলার ব্যবহারের পর থেকে মাসিক বিদ্যুৎ বিল কম আসছে। সোলার হোম সিস্টেম ব্যবহারের ফলে কেরোসিনের ব্যয় ও দূঘর্টনা থেকে বাঁচা সম্ভব হয়েছে। সৌর বিদ্যুতের কোন লোডশেডিং নেই, রক্ষণাবেক্ষণও সহজ এবং উচ্চ ভোল্টেজ না থাকায় নিরাপদ। সহজেই যেকোন জায়গাতে স্থানান্তর করা যায়।” কোরোসিনের চেয়ে সাশ্রয়ী সৌর বিদ্যুৎ প্রসঙ্গে গাইবান্ধার হাবিবুর রহমান একটি আর্থিক তুলনামূলক হিসাব তুলে ধরেন। ফুলছড়ি বাজারে হাবিবুরের একটি বেকারির দোকান ও ফ্যাক্টরি রয়েছে। দোকান ও ফ্যাক্টরিতে আলো জ্বালানোর জন্য প্রতিদিন ২ লিটার কোরোসিন তৈল প্রয়োজন হত। তৎকালীন বাজার মূল্য হিসেবে মাসে বাতি জ্বালানোর জন্য কেরোসিন বাবদ খরচ ছিল ৪৮০০ টাকা। বর্তমানে (গবেষণাকালিন সময়ে) হাবিবুর দোকান ও ফ্যাক্টরির জন্য ৬৫ ওয়াটের একটি সোলার প্যানেল ক্রয় করেছে যা দিয়ে ৭টি টিউব ও একটি সাদা কালো টেলিভিশন চালাচ্ছে। প্রথমে মোট দামের ১৫ শতাংশ দেবার পরে মাসিক কিস্তি দিতে হচ্ছে ১০১৪ টাকা এবং তিন বছর পরে হাবিবুর এই সিস্টেমটির মালিক হয়ে যাবে। এছাড়া প্রয়োজনে সিস্টেমটি স্থানান্তর করা যাবে। উপরোন্ত প্রতিমাসে হাবিবুরের বাতি জ্বালানো বাবদ আয় হচ্ছে ৩৭৮৬ টাকা। কারণ প্রতি মাসে তেল খরচ বাবদ খরচ হত ৪৮০০ টাকা কিন্তু সোলার হোম সিস্টেম বাবদ মাসে খরচ হচ্ছে মাত্র ১০১৪ টাকা।

বিদ্যু উৎপাদনের চাহিদা এবং তার সথে পাল্লা দিতে না পারায় ক্রমবর্ধমান ঘাটতিতে দেশ যখন ভয়াবহ সংকটে তখন সৌর বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তা জোরেসোরে আলোচনায় আসছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে স্থাপন করা হয়েছে সৌর বিদ্যুতের প্যানেল। নিজেদের ছাদে দেশের সম্ভবত সবচে’ বড় প্যানেল বসিয়ে চমক দেখিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রাজধানী সৌর বিদ্যুতের ব্যবহারকে উৎসাহিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক এ প্যানেল স্থাপন করেন। সৌর বিদ্যুতের এই রকম অনেক সাফল্য ও সম্ভাবনা বাংলাদেশে বর্তমানে বেশ চোখে পড়ছে। নবায়নযোগ্য শক্তি হিসেবে সৌর শক্তির ব্যবহার বাড়ানোর এ উদ্যোগ অবশ্যই ভালো। তবে তা এখনও বিদ্যুতের একমাত্র বিকল্প হিসেবে ব্যবহারের অবস্থায় নেই। একথা সত্য যে, বাংলাদেশে সৌর বিদ্যুতের প্রসার ঘটছে কিন্তু দেশের এক তৃতীয়াংশ মানুষকে দরিদ্র সীমার নিচে রেখে এবং সম্পদের ৯০ শতাংশের মালিক যে দেশের ১০ শতাংশ লোক সেই দেশে জ্বালানি শক্তির মতো বড় উদ্যোগগুলো রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। দেশের বনজ সম্পদ রক্ষা এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলার কথা মাথায় রেখে এখন থেকেই আমাদের বিকল্প জ্বালানির কথা ভাবতে হবে। কারণ ক্রমাগত জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ফলে জলবায়ুর প্রভাবজনিত নেতিবাচক প্রভাবগুলো তরান্বিত হচ্ছে। বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমেই পরিবেশের দূষণের মাত্রা কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব। এতে একদিকে যেমন জ্বালানির সাশ্রয় হবে তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতিকর প্রভাবের মোকাবেলা করাও কিছুটা হলে সম্ভব হবে।

happy wheels 2

Comments