সাম্প্রতিক পোস্ট

আলোর ছোঁয়ায় আলোকিত কর্মকার সম্প্রদায়ের জীবন

রাজশাহী থেকে উত্তম কুমার

রাজশাহী, তানোর উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামের দুই পাড়ায় প্রায় ৫০টি আদিবাসী কর্মকার সম্প্রদায়ের বসবাস। তারা সরকারি খাস জমিতে ২০১০ সাল থেকে বসবাস করে আসছেন । যদিও ভূমি রক্ষার জন্য তারা নানানভাবে সংগ্রাম করে আসছেন। বিভিন্ন সরকারি অফিস ও দপ্তরে যোগাযোগ করে তাঁরা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ পান।

তবে বসবাসের সুযোগ পেলেও দীর্ষ ১০টি বছর থাকতে হয়েছে তাঁদের বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায়। বিদ্যুৎ না থাকায় তারা নানান সমস্যায় পড়েন। তাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে গিয়ে পাঠ্যপুস্তকের যা পড়ানো হতো সেটাই শুধু পড়তে পারতো। বাসায় ফিরে যে একটু হোমওয়ার্ক করবে বা আরেকটু পড়বে সে সুযোগটা নেই। কারণ বিদ্যুৎ না থাকায় সন্ধ্যা বা রাতে তারা পড়তে পারতো না। দরিদ্র পিতামাতার পক্ষে সবসময় কেরোসিন বা মোমবাতি কেনার সামর্থ্য নেই। অন্যদিকে মোবাইল চার্জ করার জন্য তাদেরকে পাশেই বাজার বাজারে যেতে হয় এবং ১০ টাকা মোবাইল প্রতি বিল দিয়ে চার্জ করে নিতে হতো।

অন্যদিকে খাবার পানি পেতে সমস্যা হত। বাতি, হারিকেন ,মোমবাতির,কালিতে বাড়ি নোংরা হয়ে যেত। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান অন্ধকারের সম্পূর্ণ করতে হতো। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নানান ধরনের অর্থ উপার্জনের সুযোগ রয়েছে তা থেকে তারা বঞ্চিত হতো। কৃষ্ণপুর গ্রামের কর্মকারপাড়ায় সামাজিক আচার অনুষ্ঠান সংযুক্ত বাইরের মানুষ কম করতে চাইতো। অন্ধকার ও পানি না থাকায় তাদের সঙ্গে সামাজিক বন্ধনে মানুষ আসতেও সংকোচ বোধ করত।

তাদের এলাকায় বিদুৎ সংযোগ দেওয়ার জন্য নানানভাবেই তারা চেষ্টা করেছেন, অনেকের সাথে যোগাযোগ করেছেন, প্রশাসনের আবেদন করেছেন কিন্তু কোন কাজ হয়নি বিগত ১০ বছর ধরে। এই দীর্ঘ সময়ে অনেক কিছুর পরিবর্তন হলেও পরিবর্তন হয়নি তাঁদের অন্ধকার জীবনের।

২০১৯ সালে শেষের দিকে বারসিক’র সাথে এই কর্মকার সম্প্রদায়ের পরিচয় হয়। বারসিক এলাকায় কাজ করতে গিয়ে জানতে পারে যে এ এলাকার মানুষের অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে বিদ্যুৎ সংযোগ ও বসতবাড়ি না পাওয়া। মূলত তখন থেকেই বারসিক তাঁদের সাথে বিদ্যুৎ ও বসতভিটা নিয়ে কাজ শুরু করে। অন্যান্য চলমান কাজের পাশাপাশি এটাও চলছিলো। অনেক পরিকল্পনার পর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তারা বিদ্যুৎ সংযোগ পান।

বিদ্যুৎ পাওয়ার ফলে কর্মকার সম্প্রদায়ের চিত্র পরিবর্তন হয় অনেকটি। কর্মকার পাড়ার কালি কর্মকার (৫৫)বলেন, ‘বিদ্যুৎ পাওয়ার পর আমাদের ছেলে মেয়ে পড়াশুনায় খুব মনোযোগী হয়েছে। আমাদের পাড়ার চতুর্দিকে জঙ্গল ও অন্ধকারে ঢেকে থাকতো সন্ধ্যা বেলায় আমাদের পাড়ায় এখন আলোকিত হয়ে থাকে। আমরা ভালোভাবে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান করতে পারতাম না। মনে একটি সংকোচ বোধ থাকতো। এখন মন উজাড় করে ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো করতে পারি। আমাদের সঙ্গে সামাজিক বন্ধনে অন্য এলাকার লোক জড়িত হতে চাইত না। এখন আমাদের সঙ্গে সামাজিক বন্ধনে সেই সংকোচবোধ কেউ করেনা।’ তিনি আরও বলেন, ‘দীপশিখা সমিতি থেকে আমাদের মোটার ও টাংকি দিয়েছে । যেখান থেকে আমরা আমাদের খাবার পানি সংগ্রহ করতে পারি।’

ধীরেন কর্মকার (৫০) বলেন, ‘আমাদের মূল পেশা হচ্ছে লোহা দিয়ে সাংসারিক ও কৃষি কাজের পণ্য তৈরি করা। কিন্তু এই কাজটি সব সময় থাকে না। আর কাজ না থাকলে সংসার পরিচালনা করতেও খুব কষ্ট হয়। বিদ্যুৎ পাওয়ার পর কিস্তি থেকে কিছু ঋণ করে আমি একটি চার্জার ভ্যান গাড়ি কিনি। কাজের পাশাপাশি আমি এই গাড়ি চালাই। এখন আমাকে আর ওই বেকারত্ব সময়টা সম্মুখীন হতে হয় না।’

এই কৃষ্ণপুর কর্মকার পাড়াতে আরো কয়েকটি পরিবার যেমন যুধিষ্ঠি, নয়ন, বিজয়, এরা এখন চার্জার ভ্যান চালিয়ে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে পারছেন। স্মৃতি কর্মকার (২০) বলেন, ‘আমরা ভার্চুয়াল পৃথিবী থেকে অনেকটি পিছনে ছিলাম। তথ্য পেতে অনেক দেরি হতো। এখন অতি দ্রুত তথ্য পাই। কলেজের পড়াশোনার তথ্য সংগ্রহ করতে পারি।’

বিদ্যুতের আলোর মতই কর্মকার সম্প্রদায়ের ৫০টি পরিবারের জীবন আজ আলোকিত। ৫০টি কর্মকার সম্প্রদায়ের মত বাংলাদেশের প্রতিটি বাড়িই আলোকিত হোক এই আমাদের প্রত্যাশা।

happy wheels 2