দূষিত পানিই যত রোগের মূল

সাতক্ষীরা চম্পা রানী মল্লিক

খারাপ পানিই যত রোগের মূল বললেন কেওড়াতলীর নারীরা। উপকূলীয় জীবন-জীবিকায় অবাধ পানির প্রবেশ নিশ্চিত থাকলেও নিরাপদ, সুপেয় কিংবা ব্যবহার উপযোগি পানির একবারেই অনুপস্থিত। দৈনন্দিন ব্যবহার্য কাজে প্রতিনিয়ত লবণ পানির ব্যবহার করতে হয় উপকূলের সকলকে। আর এই অনুপযুক্ত পানি ব্যবহার করেই উপকূলীয় নারীস্বাস্থ্য এর উপর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। দুর্যোগ পরববর্তী কিংবা লবণ পানি ব্যবহার পরবর্তী সময়ে শিশু, প্রবীণদের পাশাপাশি নারীদের বিভিন্ন ধরনের রোগের সন্মূখীন হতে হচ্ছে।
সম্প্রতি উপকূলীয় শ্যামনগরের ঈশ্বরীপুর ইউনিয়নের কেওড়াতলী গ্রামে সূর্যমুখী নারী সংগঠনে ‘পানীয় জল ও এলাকায় পানির পরিস্থিতি’ বিষয়ক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত আলোচনায় নারী সংগঠনের ১৪ জন নারী ও এক জন বারসিক কর্মকর্তা চম্পা মল্লিক উপস্থিত ছিলেন। তিনি এই আলোচনায় এলাকার সাধারণ নারীদের কাছ থেকে খুব সহজ ব্যাখ্যার মাধ্যমে পানির বিভিন্ন পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করেন।


অংশগ্রহণকারীরা এসময় বলেন, ‘আমাদের এলাকায় ভলো পানির একমাত্র উৎস হল-পুকুর। কিন্তু সেই পুকুরের পানি ঘূর্ণিঝড় বুলবুলে গাছের ডাল, পাতা পড়ে পচে নষ্ট হয়ে গেছে। এই পুকুরটি আমাদের এলাকা থেকে এক/দেড় কিলোমিটার দূরে। এখান থেকে খাবার পানি সংরক্ষণের জন্য আমরা হাঁড়ি, কলস ও বোতল ব্যবহার করতাম। পানি সংগ্রহ করার জন্য আমাদের প্রত্যেকেরই দিনে ৪-৫ বার যাওয়া লাগে। আর এই পানি সংগ্রহের কাজটা করি আমরা নারীরা, তবে আমাদের মধ্যে যাদের মেয়ে সন্তান আছে তারা মাঝে মাঝে ওদের ‘মা’দেরকে পানি সংগ্রহের কাজে সহযোগিতা করে।’


তারা আরোও বলেন, ‘এই পানি সংগ্রহ করতে আমাদের কোন খরচ হয়না। তবে চৈত্র, বৈশাখের দিকে আমাদের খুব সমস্যা হয়, কারণ এ সময় আমাদের পানি কিনে খেতে হয়। ১০ লিটারের এক ড্রাম পানি কিনতে লাগে এবং এই পানি মাত্র এক দিন হয়। এই খরচটা আমাদের জন্য খুব কষ্টকর। তবু ও হাজার কষ্ট হলেও এটা করতে হয়, যদি ও অনেকে করতে পারেন না। কিন্তু এ সময় পুকুরে পানি এত কম হয়ে যায় যে, আর খাওয়ার উপযোগী থাকে না।’


সংগঠনের সদস্য কদবানু বিবি বলেন, ‘পূর্বে থেকেই আমরা পুকুরের পানি সংগ্রহ করতাম তবে সে সময় পানির উৎস বেশি ছিল কিন্তু এখন অনেক কমে গেছে। এই উৎসগুলো কমে যাওয়ার প্রধান কারণগুলো হলো দুর্যোগ। যেমন-প্রথমে পুকুরগুলো ক্ষতি হয় সিডরে তারপরে আইলায়। এভাবেই শেষ পর্যন্ত একটাই পুকুর ভালো ছিল কিন্তু সেটা ও শেষ হলো বুলবুলে।’


অংশগ্রহণকারীরা জানান, এভাবে ক্ষতির মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে বর্তমানে তারা খুব ভয়ানক অবস্থার মধ্যে আছেন। এখন যে পানি তারা ব্যবহার করছেন তা মোটেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। পুকুরের মাছগুলোও মরে যাচ্ছে। এ সময় আনজুরা বেগম (৫৫) বলেন, ‘ভাত কম খেয়ে থাকতে পারি কিন্তু পানি ছাড়া বাঁচি কিভাবে। তাই নিরুপায় হয়ে কখনো পানি ফুটিয়ে, আবার কখনো ফিটকিরি দিয়ে, পান করছি। এছাড়াও আমরা দু এক সময় যারা কেনা পানি নিই তাও বিদ্যুৎ না থাকার কারণে বন্ধ আছে বেশ কিছুদিন ধরে। খেতে হচ্ছে পুকুরের পানি। আর এই পানি খেয়ে দেখা দিচ্ছে বহু সমস্যা। চুলকানা, পাঁচড়া, আমাশয়, বারেবারে পায়খানা, গ্যাস্ট্রিক হয়।’


অংশগ্রহণকারীরা জানান, ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে ডাক্তার একটাই পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন তা হল- ভালো পানি খাওয়ার ও ব্যবহারের জন্য। কিন্তু তারা তা কোনভাবেই পালন করতে পারছেন না। আলোচনার এক পর্যায়ে মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘আমরা নারীরা এই ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের পর থেকে অনেক কঠিন সমস্যা ভোগ করছি, যা সবাইকে বলতে পারছিনা। আবার সহ্যও করতে পারছি না।’ তারা আরও বলেন, ‘এখানে টিউবওয়েলের পানি ভালো হয় না, অন্যান্য এলাকার মত কোন পানির ব্যবস্থা ও নেই এই এলাকায়। একমাত্র উপায় পুকুর তার ও আজ এই হাল। এমন অবস্থায় এসে আমরা ভাবছি, কেউ যদি বা কোনভাবে যদি আমাদের এই এলাকায় ড্রামের ব্যবস্থা করতো! সেটা প্রতিটি পরিবারেও যদি না হয় কয়েকটা পরিবার মিলে বড় একটি করে ড্রাম পেলে আমরা সেটাকে বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন হিসেবে মনে করতাম।’


উপকূলীয় নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানোর জন্য সরকারি বেসরকারিভাবে যুতসই ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রয়োজন। যার মাধ্যমে উপকূলীয় নারীরা নিরাপদ পানি ব্যবহার করতে পারবে যার প্রেক্ষিতে নারীদের নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবন সুরক্ষা পাবে।

happy wheels 2