কুমার:কাদা মাটির জীবন সংগ্রাম
সাতক্ষীরা শ্যামনগর থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
পৃথিবীর সৃষ্টির প্রথম নিদর্শন ও প্রথম বিজ্ঞান হল মাটির কাজ বা মৃৎশিল্প। প্রাচীনকাল থেকেই এদেশের কুমারেরা নানা রঙের নানা বর্ণের হরেক রকমের মাটির জিনিসপত্র তৈরি করে আসছেন। বাংলাদেশের প্রাচীন শিল্পকলার একটা পরিচয় পাওয়া যায় এদেশের মাটির শিল্পে। মাটির শিল্প এদেশের নিজস্ব শিল্প। গ্রামের কুমারেরা তাদের শৈল্পিক হাতে অত্যন্ত নিপুণভাবে তৈরি করে এসব মাটির জিনিস। এ শিল্পের প্রধান উপাদান মাটি। তবে সব ধরনের মাটিতে এই শিল্প হয় না। এর জন্য প্রয়োজন হয় পরিস্কার অর্থাৎ কাঁকড়, নুড়ি, পাথর ছাড়া এঁটেল মাটি; বেলে কিংবা দোঁআশ মাটি দিয়ে এ শিল্প তৈরি হয় না। কারণ এ মাটি অনেকটা নরম প্রকৃতির। কিন্তু এঁটেল মাটি বেশ আঠালো ও শক্ত গোছের হয়। ফলে এ শিল্প তৈরিতে এঁটেল মাটি বেশি উপযোগী বলে জানান শ্যামাপদ পাল।
শ্যামাপদ পাল সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার নূরনগর ইউনিয়নের নূরনগর গ্রামের একজন মৃৎ শিল্পী। ছেলেবেলা থেকে বাপ-ঠাকুরদার সাথে থেকে কাজ শিখে আজও ধরে রেখেছেন এই মাটির শিল্প পেশাকে। ঠাকুরদার বংশধরদের মধ্যে বর্তমানে ৮টি পরিবার এই গ্রামে অবস্থান করছেন। এই শিল্পকে ধরে রাখতে শুরু থেকেই তারা নিজস্ব ৪ বিঘা জমির মাটিই ব্যবহার করতো। এর পাশাপাশি উপযুক্ত মাটি পেলে অন্যের জমি থেকে মাটি কিনে নিয়ে ব্যবহার করেন। নিজেদের জমির মাটি ব্যবহারের ফলে জমি অনেক নিচু হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে অনেকটা অন্যের জমির উপর নির্ভর করতে হয় তাদেরকে। প্রায় ৪/৫ কিমি দূর থেকে মাটি সংগ্রহ করতে হয়। নির্দিষ্ট একটা সময়ে জমি মালিকদের সাথে চুক্তি করে ৫০০/৬০০ দরে মাটি কিনে নিতে হয়। এই মাটি তুলতে আবার মজুর লাগে। মাটি উঠানোর পরে সেই মাটি আবার ভ্যান ভাড়া করে বয়ে (বহন) নিয়ে আসতে হয়। এক ভ্যান মাটি আনতে খরচ পড়ে প্রায় ৬০ টাকা। ঐ মাটি পেজে বা ছেনে দুই দিন ধরে ফিনিশিং করতে হয়। এরপর এটি ব্যবহার উপযোগী হয়। মাটি ব্যবহার উপযোগী হলে চাকে তুলে কুমারের যতœ, শ্রম ও কুশলী হাতের ছোঁয়ায় এক একটি রূপ নেয়। তৈরি হয় মাটির কলস, হাঁড়ি, জালা, ভাঁড়, ডাবুর, কড়া, খোলামুচি, হাঁড়া, মেটে, কলকে, খুলি, প্রদীপদানি, পাখি, মোরগ, ঢাকনা, প্রতিমা, প্রদীপ, মাছ, মাটির ঘট (ব্যাংক) প্রভৃতি জিনিসপত্র।
এ সমন্ত জিনিস রোদে শুকিয়ে দিতে তারপর পুড়ানো হয়। পুঁড়িয়ে আবার কোন কোন জিনিসে রঙ করতে হয়। পোঁড়ানোর ক্ষেত্রে জ্বালানিও একটা খরচ। তাদের মতে, “আগে একটা জিনিস যে দামে বিক্রি হতো এখনও সেই দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। দামের পরিবর্তন হচ্ছে না। কিন্তু আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়েই চলেছে।” সভ্যতায় কুমারদের অবদান অনেক।
কুমারদের থেকে শিক্ষা নিয়ে উদ্ভাবিত হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি। আর আধুনিক প্রযুক্তির উদ্ভাবনের ফলে গ্রামাঞ্চল কি শহরাঞ্চলে ঘরে ঘরে প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের জিনিসের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। মাটির জিনিসের চাহিদা দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে। আর এর প্রভাব পড়ছে নতুন প্রজন্মের মধ্যে। শ্রম, খরচ ও বাজারদর হিসাব করে নতুন প্রজন্ম এ পেশার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করছে কম। অনেকে লেখাপড়া করে চাকরি বা ব্যবসার প্রতি ঝুঁকছেন। আবার কেউ মাটির কাজে ইট ভাটায় যাচ্ছেন। কেউ বা পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে। ফলে একটা সময় বাপ ঠাকুরদার এই ঐতিহ্যগত পেশাকে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন শ্যামাপদ পাল। শ্যামাপদ পালের কথার জের ধরে কৃষ্টপদ পাল বলেন,“অত্যাধুনিক ও প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নতুন নতুন মাটির জিনিস তৈরির ব্যবস্থা করা ও যে সমস্ত জায়গায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার আছে, আমাদেরকে যদি যে সমস্ত জায়গা দেখানো যেত, তাহলে যুগসই পণ্য তৈরিতে কাজে লাগত ও অভিজ্ঞতা হতো। এই প্রতিযোগিতার বাজারে হয়তো টিকে থাকা সম্ভব হতো।”
মাটির শিল্প আমাদের ঐতিহ্য ও গর্ব। মাটির সাথে মানুষের দেহের একটা সম্পর্ক আছে। মাটির জিনিস স্বাস্থ্যসম্মত। কোন রকম কেমিক্যাল ছাড়াই মাটি ব্যবহার করে জিনিস তৈরি হয়। এ শিল্পের নিদর্শন থেকে প্রমাণ মেলে যে, এদেশের মানুষেরা কতটা শিল্পমনা ছিল। বর্তমান সভ্যতার কারণে এই আদি প্রযুক্তি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। শুধু এঁটেল মাটি হলেই যে মাটির শিল্পের কাজ করা যাবে তা নয়। এর জন্য প্রয়োজন যতœ আর শ্রম। দরকার হাতের নৈপূণ্য ও কারিগরি জ্ঞান। এ শিল্প আমাদের ঐতিহ্যের ধারাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এগুলো সংরক্ষণে আমাদের সকলেরই যতœবান হওয়া জরুরি। এ শিল্প ধরে রাখতে প্রচার-প্রচারণা ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের সুব্যবস্থাও জরুরি। তাহলে নতুন প্রজন্মকে উৎসাহিত করতে ভূমিকা রাখবে।