হাওরাঞ্চলের কৃষাণীদের জন্য সমতলের কিশোরীদের উদ্যোগ
নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং
বর্তমান সময়টি ভরা আষাঢ় মাস। এ সময়টিতে ভাটি অঞ্চলের চারিদিক পানিতে থৈ থৈ করছে। বসতবাড়ি ভিটা ছাড়া সমস্ত জায়গায় শুধু পানি আর পানি, এমনকি যোগাযোগের অন্যতম রাস্তাগুলোর অধিকাংশই পানিতে নিমজ্জিত। নেত্রকোনা জেলার মদন উপজেলার অধিকাংশ এলাকা হাওর অধ্যুষিত। মদন উপজেলার গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের পুরোটাই পানিতে নিমজ্জিত। তবে দক্ষিণ মদন ইউনিয়নটি অপেক্ষাকৃত সমতল এবং উঁচু। গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের সমস্ত জমি এক ফসলী এবং শুধুমাত্র বোরো মৌসুমে ধানের চাষ হয়। শীতকালে কিছু কিছু সবজি চাষ হলেও বর্ষা মৌসুমে সবজি চাষ হয়না বললেই চলে। বসতভিটায় সামান্য পরিমাণ জমি থাকলেও গবাদি পশু-পাখি পালন করায় এবং প্রচন্ড বাতাসে মাঁচা ভেঙ্গে পড়ায় হাওরের মানুষ সেখানে সবজি চাষ করেনা।
বারসিক এপ্রিল ২০১৮ থেকে মদন উপজেলার গোবিন্দশ্রী ও মদন সদর ইউনিয়নে একবছর মেয়াদী একটি প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু করে। বারসিক এলাকার জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ ও চাহিদা জানার চেষ্টা করে। তথ্য সংগ্রহ থেকে দেখা যায়, মদন সদর ইউনিয়নে খুব সামান্য পরিমাণে বসতভিটায় সবজি চাষ হলেও গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নে তেমন কোন সবজি চাষ হয় না জায়গার অভাবে। গ্রাম সভার মাধ্যমে বসতভিটায় সবজি চাষে কৃষক-কৃষাণীদেরকে উৎসাহিত করা হলে তারা সীম, মিষ্টিকুমড়া, লাউ, চালকুমড়া, পেঁপে ও বারোমাসি মরিচের চাষ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু কৃষকদের এই আগ্রহে বাধা হয়ে দাঁড়ায় মানসম্মত স্থানীয় জাতের বীজের দুষ্প্রাপ্যতা।
বর্ষা মৌসুমের স্থানীয় জাতের সবজি বীজের অভাব ও হাওরাঞ্চলের কৃষক-কৃষাণীদের আগ্রহের কথা আটপাড়া উপজেলার স্বরমুশিয়া ইউনিয়নের ঘিডুয়ারী গ্রামের কিশোরী সংগঠনের সদস্য ও গ্রামের কৃষাণীদের সাথে আলোচনা করা হয়। কিশোরী সংগঠনের সদস্যরা হাওরাঞ্চলের কৃষক-কৃষাণীদের সবজি চাষে আগ্রহের কথা শুনে তাদের গ্রামের কৃষক-কৃষাণীদের নিকট থেকে স্থানীয় জাতের মানসম্মত সবজি বীজ সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কিশোরীরা গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুড়ে কৃষক-কৃষাণীদের কাছ থেকে তাদের সংরক্ষিত সবজি- চার জাতের সীম, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, বরবটি ও মরিচের বীজ সংগ্রহ করে হাওরাঞ্চলের কৃষক-কৃষাণীদের মধ্যে বিতরণের জন্য বারসিক’র কর্মীর নিকট হস্তান্তর করে। কিশোরী সংগঠনের সদস্যরা ও গ্রামের কৃষাণীরা চলতি মৌসুমে বসতভিটায় সীম, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, মরিচ ও পেঁপে চাষ করে পরবর্তী মৌসুমে আরও বেশি করে হাওরাঞ্চলের কৃষকদের বীজ দেয়ার জন্য বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নিয়েছে।
কিশোরী সংগঠনের সদস্য জান্নাতুল ফেরদৌস এ সম্পর্কে তার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, “আমাদের এলাকার মত হাওরাঞ্চলের কৃষাণীরাও তাদের বসতভিটায় বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করে পুষ্টির চাহিদা মিটাক। সবজি চাষ করে তারাও যাতে বীজ সংরক্ষণ করতে পারেন। হাওরাঞ্চলের কৃষকরা আমাদের মত সবজি চাষ করলে সবজির জন্য তাদের বাজারের উপর নির্ভর করতে হবে না। হাওরাঞ্চলে শুধু জলজ প্রাণ নয়, সবজিসহ সকল কৃষি প্রাণবৈচিত্র্যও বৃদ্ধি পাবে।”
ঘিডুয়ারী কিশোরী সংগঠনের সকল সদস্যই স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী। লেখাপড়ার পাশাপাশি তারা বসতভিটায় বৈচিত্র্যময় সবজি ও ফলের চাষ করে। উৎপাদিত সবজি ফসলের বীজ তারা সংরক্ষণ করে এবং পরস্পরের সাথে বীজ বিনিময় করে। হাওরাঞ্চলের কৃষক-কৃষাণীদের জন্য কিশোরী সংগঠনের সদস্যদের সবজি বীজ সংগ্রহের উদ্যোগটি সত্যি প্রশংসার দাবিদার।