প্রিয় জীবন

সিলভানুস লামিন
প্রিয় জীবন, তোমাকে নিয়ে আমি কী লিখবো? তুমি আসলে কি? তুমি কি মানুষের বাম বুকের একদম কেন্দ্রে অবস্থানকারী সেই দৃশ্যমান ‘হৃদয়’ সদৃশ স্পন্দিত একটি অঙ্গ? নাকি তুমি মস্তিষ্ক ও ‘হৃদয়’ সদৃশ অঙ্গটির সমন্বিত একটি রূপ? তোমাকে কেউ কেউ ‘সময়ের সমষ্টি’ হিসেবেও দেখে। কারণ একটি নির্দিষ্ট সময়ে তোমার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায় পৃথিবী থেকে বলে! তবে বিজ্ঞানের ভাষায় প্রিয় জীবন, তুমি একটি উন্মুক্ত প্রক্রিয়া, যার বিভিন্ন কোষ আছে, পরিপাক প্রক্রিয়া আছে, রয়েছে একটি জীবনচক্র, যার বৃদ্ধি আছে, যে উদ্দীপকের প্রতি সাড়া দেয়, যেকোন পরিবেশে খাপখাওয়ানোর ক্ষমতা আছে, শ্বাসতন্ত্র আছে, বংশবৃদ্ধি করে ও উন্নতি করে। কিন্তু সামাজিক ও দর্শনের দিক থেকে প্রিয় জীবন, তোমাকে কেউ কেউ পরিশ্রমী, দরিদ্র কিংবা নিম্ন মধ্যবিক্ত মানুষের সংগ্রামময় জীবনের ব্যর্থতামাখা একটি দীর্ঘশ্বাস হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে। কেউ আবার তোমাকে সফল, বিজয়ী ও ধনাঢ্য মানুষের সাফল্যমণ্ডিত অব্যক্ত অনুভূতি হিসেবে আখ্যায়িত করে? কেউ কেউ তোমাকে সন্তানকে দুঃখীনি মায়ের পরম মমতায় ও ভালোবাসায় স্নাত করার ভূতপূর্ব দৃশ্যের সাথে তুলনা করে। কেউ কেউ আবার তোমাকে প্রিয়ার লাবণ্যময়, স্নিগ্ধ ও অনুরাগমাখা সেই চাহনী মনে করে। তোমাকে কেউ কেউ পিতৃপ্রেম, মাতৃপ্রেম, সন্তানপ্রেম, প্রাণ-প্রকৃতিপ্রেমও বলে মনে করে। প্রিয় জীবন, মানুষ ও বিভিন্ন জীবনসত্তা তাদের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে তোমাকে এরকমই নানানভাবে সংজ্ঞায়িত করে এবং নানান পারিপার্শ্বিকতা ও অভিজ্ঞতার সাথে তুলনা করে।

প্রিয় জীবন, কারও কাছে তুমি ভালোবাসা, কারও কাছে তুমি দায়িত্বশীলতা, কারও কাছে তুমি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা এবং কারও কাছে তুমি শ্রদ্ধাশীলতা। দার্শনিক এরিস্টটলের কাছে তুমি সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যতা। তাঁর কাছে তোমার অর্থ ও লক্ষ্যই হচ্ছে সুখী থাকা। তবে প্রিয় জীবন, আমার কাছে তুমি তার থেকেও বেশি কিছু। তোমাকে কোন সংজ্ঞার ভেতরে আটকে রাখতে পারবো না আমি। তোমার অদৃশ্য নানান রূপ ও রঙ রয়েছে, রয়েছে তোমার উদ্দেশ্য ও অর্থ, রয়েছে তোমার বাসনা, প্রত্যাশা ও আকাঙ্খা। তুমি ঠিক জলের মতো, যে পাত্রে তোমাকে রাখা হবে তুমি সেই পাত্রের রূপ নাও। তুমি ঠিক সেই বস্তুর মতো যে মুহুর্তে মূহুতে রঙ বদলায়!

প্রিয় জীবন, তুমি যখন ছোট্ট শিশুর ছোট্ট শরীরে থাকো তোমাকে কত সরল, কত নিষ্পাপ দেখায়। তোমার চাওয়াগুলোও কত সীমাবদ্ধ। তোমার কোন লোভ ও লালসা নেই। তোমার কোন প্রত্যাশা নেই কারও কাছে, স্বপ্নগুলোও কত ছোট্ট, কত আকর্ষণীয়! তোমার মুখের ভাষাটি কত পরিশুদ্ধ, কত নিষ্পাপ, কত পবিত্র। তোমার মুখে কোন কটু কথা নেই, নেই নোংরামী। অপ্রাপ্তি তোমাকে কখনও কাঁদায় না, কখনও হতাশাগ্রস্ত করে তুলে না। জটিলতা কি জিনিস সেটা তো তুমি জানই না! তোমাকে সবাই আদর করতে চায়, ভালোবাসতে চায়, কোলে তুলতে চায়। তোমাকে ঘিরে সবাই আনন্দ করে, উল্লাস করে, তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। তোমার এ রূপটি সত্যিই চমৎকার ও খুবই আকাঙ্খিত সবার কাছে।

প্রিয় জীবন, সময়ের পরিক্রমায় তুমি যখন কৈশোরের দেহে নিজেকে ধারণ কর তখনও পর্যন্ত তোমাকে দারুণ লাগে, ভালো লাগে। তোমার চোখে নানান রঙিন স্বপ্ন। পৃথিবীকে সমৃদ্ধ করার জন্য নিজেকে নানানভাবে তৈরি কর। শিক্ষায়, দক্ষতায়, অভিজ্ঞতায় ও সৃষ্টিশীলতায় এ ধরাকে নতুন রূপে সাজানোর ইচ্ছাশক্তি জাগে তোমার ভেতরে। এ সময় তোমার মধ্যে কোন ভনিতা নেই, কোন ভ-ামী নেই। সবকিছুই তোমার কাছে রঙিন বলে মনে হয়। তুমি এ সময় আকাশে উড়ার স্বপ্ন দেখ, আকাশকে ছোঁতে চাও, সমুদ্রে গভীরে গিয়ে সৃষ্টির রহস্য উন্মোচন করার বাসনা জাগে তোমার ভেতরে। তুমি পরাধীনতাকে ঘৃণা কর, স্বাধীন ও উন্মুক্তভাবে তুমি সামনে এগিয়ে যেতে চাও। তুমি যেন আত্মবিশ্বাসী এক সৈনিক!

প্রিয় জীবন, সময়ের সাথে সাথে তুমি যখন তরুণ-তরুণীর দেহে ধারণ কর, তখন তুমি শক্তিতে, তারণ্যে ভরপুর একটি জীবন। যে কোন কিছু সম্পাদন করার ক্ষমতা তোমার আছে এই সময়। একাডেমিক শিক্ষায় কিংবা কারিগরি বা অন্য কোন শিক্ষায় নিজেকে গড়ে তুমি স্বপ্ন দেখ নিজের পথচলাকে নিজেই নিয়ন্ত্রণ করতে, নিজের এবং পরিবারের দায়িত্ব নিজেই কাঁধে তুলতে। এ সময় তোমার ভেতরে রয়েছে অমিত সম্ভাবনা, বিষ্ময়জাগানিয়া সৃজনশীলতা। এ সময়ই তুমি দেশ, সমাজ ও পরিবারের জন্য একজন সম্পদব্যক্তি হিসেবে পরিণত হতে শুরু কর। তোমাকে নিয়ে তোমার অভিভাবক ও শুভাকাঙ্খিরা স্বপ্ন দেখেন, তাদের আশা ও আকাঙ্খার প্রতীকে পরিণত হও তুমি। এ সময়ই তুমি সিদ্ধান্ত নাও নতুন সংসারে প্রবেশ করার, নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার। প্রিয় জীবন, তবে নানান পারিপার্শ্বিকতা তোমাকে প্রভাবিত করে এ সময়। দিকনির্দেশনা ও সঠিক তত্ত্বাবধানের অভাবে এই সময়ে তুমি বিপথে যেতে পার। এ সময় থেকে তুমি জটিল হতে শিখ। তোমার প্রত্যাশা ও আকাঙ্খা পূরণ না হলে তুমি হতাশাগ্রস্তও হও।

প্রিয় জীবন, একটা সময় আসে যখন তুমি পরিপক্ক একজন মানুষের জীবন ক্যানভাসে প্রবেশ কর। এ সময় থেকে তোমার মধ্যে সেই সরলতা ও নিষ্পাপ অবয়ব নেই, দায়িত্ববোধের চাপে তুমি ইস্পাত শক্ত চোয়ালে এগিয়ে চল কর্মক্ষেত্রে। কখনও তুমি শ্রান্ত, ক্লান্ত, কখনওবা তুমি সজীব ও উৎফুল্ল। দীর্ঘ এই চলার পথে সমাজ, পরিবার ও দেশ নিয়ে তোমার চিন্তা, মতামত, মূল্যায়ন এবং ধারণা সময়ভেদে পরিবর্তন হয়। বিভিন্নজনের সাথে মিথস্ক্রিয়ায় এই সময় তুমি অনুধাবন কর তুমি এখন জটিলতায় আবদ্ধ। নিজের অর্জন, প্রাপ্তি নিয়ে অনেকক্ষেত্রে তুমি সন্তুষ্ট নও। তুমি আরও অর্জন করতে চাও, আরও সাফল্য লাভ করতে চাও। তোমার চাওয়ার পরিধি ক্রমেই বৃদ্ধি পায়। এ সময় অপ্রাপ্তি তোমাকে হতাশাগ্রস্ত করে, সাফল্য তোমাকে সুখানুভুতি দেয়। সাফল্য পাওয়ার জন্য তুমি এ সময় স্বার্থপর হতে শুরু কর, আত্মকেন্দ্রিক হতে শুরু কর। তোমার জগতটা কেবল তোমাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। নিজের সুখ ও সাফল্য ছাড়া তুমি আর কিছুই ভাবতে পার না। প্রিয় জীবন, এ সময় তোমার ভূমিকা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারী থেকে পরিবর্তিত হয়ে সিদ্ধান্ত প্রদানকারীতে রূপ নেয়। সন্তানের ভবিষ্যত গড়া নিয়ে প্রতিনিয়তই তুমি নিজের ও অন্যের সাথে লড়াই করে যাও। জীবন সংসারের ভারে ও চাপে ন্যুজ্ব হয়ে অনেক সময় তুমি ক্ষিপ্তও হয়ে ওঠ। তারপরও তুমি নিজের দায়িত্ববোধ ও ভূমিকা পালনের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাও।

প্রিয় জীবন, এক সময় তুমি আবিষ্কার কর, এই সংসার, এই জগত তোমার জন্য নয়। এই সংসারে, জগতে তোমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। তুমি জীবনচক্রের একটি অন্তিম সময়ের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছ। তুমি এখন পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েছ। যাদেরকে তুমি তিলে তিলে গড়ে তুলে এসেছে তারাই তোমার ভূমিকা পালন করছে। কারও কাছে তুমি এখনও সম্পদব্যক্তি আবার কারও কাছে তুমি বোঝা! তুমি হয়তো এ সময় লক্ষ্য কর কারও কাছে তোমার মতামত আগের মতোই প্রাধান্য পাচ্ছে, কারও কাছে সেই মতামত ধুলার মতোই মূহুর্তে উড়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তোমাকে আগের মতেই শ্রদ্ধা করছে, কেউবা করছে না। অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করেই এ সময় তোমার সময় কাটে। প্রিয়জনের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য সবসময় ব্যাকুল থাক। জগত থেকে প্রস্থান করার জন্য এ সময় তুমি প্রস্তুতিও গ্রহণ কর।

প্রিয় জীবন, তোমার চরিত্রটি সত্যিই বৈচিত্র্যময়। মানুষ ও বিভিন্ন জীবন্ত সত্তার জীবনচক্রে তোমার বিচিত্র রূপ দেখতে পাই। আমার এ শরীরে নানান সময়ে তোমার নানান চরিত্র দেখতে পাই আমি। কখনও তুমি খুব আশাবাদী, আত্মবিশ্বাসী, কখনও নৈরাশ্যবাদী, কখনও উৎফুল্ল, কখনো বিষাদগ্রস্ত। কখনওবা তুমি প্রেমময়, কখনওবা তুমি ক্রোধান্বিত। প্রিয় জীবন, কখনও তুমি কোমল, শোকসন্তপ্ত কখনওবা তুমি হিংস্র, হিংসুটে, সন্দেহপ্রবণ, স্বার্থপর! প্রিয় জীবন, কখনও সামান্য প্রাপ্তিতেই তুমি সন্তুষ্ট হও। আবার কখনও কখনও অনেক বেশি প্রাপ্তি ও অর্জনও তোমাকে সন্তুষ্ট করে না। কখনও খোলা আকাশের নীচে বসবাস করেও অনেক সুখী দেখায় তোমাকে, তোমার চাহিদা কম। আবার কখনও সুরম্য অট্টলিকায় ও নানান সুবিধাদি নিয়ে বাস করেও তোমাকে গোমড়ামুখে থাকতে দেখি। তোমার চাহিদার যেন শেষ নেই। কখনও আবার দেখি নামমাত্র টাকা আয়েও তুমি দিব্যি সংসার চালিয়ে যাচ্ছ, আবার কখনও কোটি টাকা আয়েও তুমি তোমার চাহিদা পূরণ করতে পার না। প্রিয় জীবন, কখনও কারও কষ্টে তোমাকে কাঁদতে দেখি আবার কখনও কারও কষ্টে সেই তোমাকেই উল্লাস করতে দেখি। কখনও তোমাকে অন্যের উপকার ও সহযোগিতা করতে দেখি আবার কখনও সেই তোমাকেই অন্যের ক্ষতি ও অপকার করতে দেখি। প্রিয় জীবন, কখনও তোমাকে অমায়িক, ভদ্র, সত্যবাদী, সহনশীল হতে দেখেছি আবার কখনও সেই তোমাকেই অন্যের সাথে অভদ্র আচরণ করতে দেখি, মিথ্যাচার করতে দেখি। প্রিয় জীবন, এ জগতে তোমার বৈচিত্র্যময় চরিত্র নিয়ে লিখে শেষ করা যাবে না; ভাষা কুলাবে না!

প্রিয় জীবন, তুমিই একমাত্র বিশেষ কিছু, যা কোন মানুষ কখনও হারাতে চায় না। বিশেষ করে শারীরিক, মানসিক ও মনস্তাত্তিকভাবে সুষ্ঠু সবল মানুষ তো কখনও তোমাকে হারাতে চায় না। তাদের স্বপ্ন, পরিকল্পনা এবং ইচ্ছাশক্তি দেখলে মনে হয় যদি সম্ভব হয় তারা তোমাকে অনন্তকালের জন্য নিজেদের কাছেই রাখতে চাইবে! প্রিয় জীবন, তুমি সত্যিই অনন্য, তুমি সত্যিই বিশেষ কিছু। কোন জিনিসের প্রতি খুব আকাঙ্খিত থাকলেও একসময় সেটি মানুষের কাছে পানসে হয়ে যায়, কোন দূর্লভ বস্তু পাওয়ার জন্য মানুষ হাজার শ্রম ও সংগ্রাম করলেও এক সময় সেটির প্রতিও তার আগ্রহ কমে যায়। প্রেমিক বা প্রেমিকার মন পাওয়ার জন্য মানুষ শত সহস্রবার সাধনা করলেও এক সময় তাদের প্রতিও বিরক্তি প্রকাশ ঘটে! কিন্তু প্রিয় জীবন, তোমার প্রতি কোন প্রাণের কোন অনাসক্তি নেই, কোন বিরক্তি নেই। প্রাণ আছে এমন সব সত্তার কাছে তুমিই খুবই মূল্যবান। প্রিয় জীবন, এরিস্টটলের মতে, তোমার অর্থ ও উদ্দেশই হচ্ছে একটি সুখী জীবনপ্রবাহ পরিচালনা করা। তবে সুখ তখনই পাওয়া যায় যখন তুমি অন্যকে সুখ দাও। আমরা সবাই এ জীবনে সুখী হতে চাই। প্রিয় জীবন, প্রিয়জনসহ অন্যান্য প্রাণ ও সত্তাকে ভালোবাসার মাধ্যমেই সুখী হওয়া যায়। আমরা সবাই তোমার অর্থ ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে চাই নিজেকে এবং অন্যকে সুখী রাখার মাধ্যমে। এটাই তো তুমি চাও তাই না প্রিয় জীবন?

happy wheels 2

Comments