নিরাপদ সবজির যোগানদাতা কৃষক সন্তোষ মন্ডল
মানিকগঞ্জ থেকে শিমুল বিশ্বাস
আজ থেকে ৪৪ বছর আগে এইসএসসি পাশ করেছেন। ইচ্ছা করলে চাকুরি করতে পারতেন। তথাপি কৃষিকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছেন কৃষক সন্তোষ মন্ডল। মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার বলধারা ইউনিয়নের বাংগালা গ্রামে তার পৈত্রিক নিবাস। ছোটবেলায় নিজের বাবার হাত ধরে কৃষি কাজে পদার্পন। সেই থেকে আজ অবধি নিষ্ঠার সাথে নিজস্ব জ্ঞানের আলোকে কৃষি কাজ করে চলেছেন তিনি। ধান, পাট, ডাল, তেল জাতীয় ফসল চাষ করলেও বারোমাসী সবজি চাষই তার অন্যতম ফসল। এ বিষয়ে এলাকায় তার যথেষ্ট সুনামও রয়েছে। মানুষ জানে এলাকায় কোথাও সবজি পাওয়া না গেলেও সন্তোষ মন্ডলের বাগানে সবজি পাওয়া যাবে।
সন্তোষ মন্ডলের সবজি চাষের জন্য আছে ৩০ শতাংশ উপযুক্ত জমি। এই জমিতেই নিয়মিত মিশ্র সবজি চাষ করেন অভিজ্ঞ এই প্রবীণ কৃষক। এই জমিতেই মূলা, পুইশাক, সীম, বেগুন, ডাটা, পানি লাউ, মিষ্টি লাউ, করলা, বরবটি, লালশাক, পালংশাক, কপি প্রভৃতি চাষ করে বাংগালা, নবগ্রাম, গোলাইসহ আশপাশের এলাকার মানুষের নিরাপদ খাদ্যের যোগান দিয়ে চলেছেন ৬৫ বয়সী এই কৃষক। পর্যায়ক্রমে বারোমাস তিনি এসব সবজি চাষের আওতায় এনে প্রতিবছর লক্ষ্যাধিক টাকার সবজি বিক্রি করে তিনি এখন প্রতিষ্ঠিত। তার ভাষ্যমতে, চলতি মৌসুমে শুধু ২৫ হাজার টাকার ডাটা বিক্রি করেছেন তিনি। এছাড়া লালশাক, কপি, লাউ বিক্রি করেও মোটা অংকের টাকা আয় করেছেন।
বাড়ির অতি নিকটেই বাংগালা বাজার। এই বাজারে নিয়মিত সবজি বিক্রি করেন তিনি। এ ক্ষেত্রে নিয়মিত সবজি বিক্রেতা হিসাবে বাংগালা বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য এই বারোমাসী সবজি উৎপাদকের। এমন কোন দিন নেই যে সন্তোষ মন্ডলের সবজি বাজারে যান না। এ বিষয়ে এক ক্রেতা কহিনুর রহমান বলেন, ‘সন্তোষ কাকা যদি বাজারে না আসে তাহলে আমি মনে করি হয়তো বা কাকা অসুস্থ হয়েছেন।’ তার সবজির জন্য ক্রেতার আগ্রহের শেষ নেই। কারণ তার সবজি নাকি আগুনে দিতে দিতেই রান্না হয়ে যায়। আর স্বাদ সে তো বলা বাহুল্য! বাজারে তার সবজির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ৩০ থেকে ৪০ জনের উপর রয়েছে তার নিয়মিত সবজি ক্রেতা। অনেক প্রতিবেশী তার বাগান থেকেই সবজি ক্রয় করে নিয়ে যায়। সফিক আহম্মদ হিরো নামের এক ক্রেতা বলেন, “সন্তোষ কাকার সবজি পেলে আমি আর কারো সবজি কিনি না। কারণ তার উৎপাদিত অধিকাংশ সবজিই নিরাপদ। তিনি কোন সবজি উৎপাদনে কোন ক্ষতিকর উপাদান ব্যবহার করেন না। বিষয়টি এলাকার অনেকেই জানে। যে কারণে তার সবজির এতো কদর।”
সন্তোষ মন্ডল একজন আদর্শ কৃষক। কৃষি কাজের সকল কৌশল তার নিয়ন্ত্রণে। কৃষিতে ব্যবহার করেন স্থানীয় জাতের বীজ। সব ধরনের বীজ তিনি নিজে সংরক্ষণ করেন। তিনি এমন সব পদ্ধতি অবলম্বন করেন যা অন্য কৃষকদের থেকে একটু আলাদা। কৃষিতে স্থানীক জ্ঞানের প্রয়োগকেই তিনি বেশি প্রাধান্য দেন: যেমন মরিচ এবং কচু লাগানোর পর তার নিচ দিয়ে আমন ধানের (খড়) নাড়া বিছিয়ে দেওয়া অন্যতম। তিনি বলেন “নাড়া মাটির ভিতরে রস ধরে রাখতে সহায়তা করে। ফলন ভালো হয়। ফুল, ফল উভয়ই ভালো হয়। মাঝে মাঝে পানি দিলে ওই নাড়া পচে ভারী হয়। এতে মাটির নিচে জল ধরে রাখতে সহায়তা করে। একটা সময় ওই নাড়া পচে জৈব সারে পরিণত হয়ে যায়। মাটিতে জৈব গুনাগুণ বৃদ্ধি পায়।” তাছাড়া বাড়ির সামনে গর্ত করে জৈবসার সেড তৈরি করেছেন তিনি, তৈরি করেছেন কেঁচো সার। গরুর যে গোবর পাওয়া যায় সবটুকু গোবর দিয়েই জৈব সার তৈরি করেন তিনি। অন্যদিকে উঠান ঝাড়ু দেওয়া মাটিও একটি গর্তে ফেলেন। প্রতি ৩ মাস পর পর সার উত্তোলন করেন। বস্তা ভর্তি করে রেখে দেন এ সব সার। প্রয়োজন অনুযায়ী জমিতে প্রয়োগ করেন। সবজি চাষ করার আগে মাটিতে গর্ত করে রাখেন। চারা রোপণের দু’একদিন আগে গর্তে জৈব সার প্রয়োগ করেন। সামান্য পানি দিয়ে মাটি ভিজিয়ে কাদার মত করেন। আবার ঝুড়ঝুড়ে হলে সবজি চারা রোপণ করেন।
অন্যদিকে পোকামাকড় দমনের জন্য ব্যবহার করেন নিমপাতা, মেহগনি ফলের তৈরি ঔষধ। ফলের পুষ্টির জন্য ব্যবহার করেন ফার্মেন্টেড প্লান্ট জুস। যে কারণে তার উৎপাদিত সবজিতে না থাকে কোন ধরনের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি। এ বিষয়ে সন্তোষ মন্ডল বলেন, “আমি সবজি বিক্রি করে সংসার চালাই এ কথা ঠিক। তবে মানুষের কথাও আমি ভাবি। যে কারণে আমি বাজারের সার এবং কীটনাশক কোন সবজিতে ব্যবহার করি না।’
জমির সঠিক ব্যবহার তিনি করতে জানেন। এর জন্য তিনি গ্রহণ করে থাকেন অভিনব এক কৌশল। একটা ফসল চলাকালীন সময়ের মধ্যে পরবর্তী ফসলের চারা তৈরি শেষ করেন তিনি। যখন একটা ফসল শেষ পর্যায় চলে আসে তখন পূর্বে তৈরি করে রাখা চারা লাগিয়ে দেন এবং পুরাতন গাছ সরিয়ে ফেলেন। সবজি বাগানের আইলে লেবু, সজেনা, পেঁপে, জাম্বুরা এগুলো চাষ করেন। তাঁর কাছে অনেকেই আসে কৃষিবিষয়ক পরামর্শ গ্রহণের জন্য। তাছাড়া এই ধরনের কৃষি চর্চার কারণে সরকারের কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে তিনি খুবই জনপ্রিয়। তার সবজি চাষ অনুসরণ করে একই গ্রামের জয়নাল আবেদীন, আ. লতিফ মিয়া, ধীরেন সরকার ,বাসন্তী রানী, অমলা রাণী সবজি বাগান গড়ে তুলেছেন।
উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ৩০ শতাংশ জমি নিয়ে সবজি বাগান আরম্ভ করলেও আজ তিনি ১২ বিঘা জমির মালিক। এলাকার মানুষের কাছে তিনি নিরাপদ সবজির যোগানদাতা সাচ্চা কৃষক।