মানুষের পাশে উপকূলীয় এলাকার যুবরা
সাতক্ষীরার, শ্যামনগর থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
প্রতিটি দেশের উন্নয়ন ও সফলতার পিছনে যুবদের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।যে দেশের যুবরা যতো বেশি কার্য়কারী এবং দায়িত্ববান সে দেশ ততো বেশি উন্নত হয়। আর একটি দেশের উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে এ যুব সমাজ। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশের যুবরাও কিন্তু কোন ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। দেশ গঠন ও দেশের উন্নয়নে তাদের অবদানের কথা বলে শেষ করার মতো নয়। সেই স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পযর্ন্ত তারা নানান ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলেছেন।তার এক দৃষ্টান্ত উপকূলীয এলাকার যুব স্বেচ্ছাসেবক টিমের।
বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় নভেল করোনা ভাইরাস। যার ছোবলে গোটা বিশ্ব যেন আজ হতবিহবল। প্রতিটি দেশ যেন নাকানি চোখানি খাচ্ছে। প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কি করে এ করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ করা যাবে। কি করে বিশ্বকে রক্ষা করা যাবে। প্রতিটি দেশ এ ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য নানান ধরনের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে চলেছে। আমাদের দেশ বাংলাদেশও করে যাচ্ছে তার নিজস্ব কায়দায়। আর এটিকে প্রতিরোধেরে জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের পাশে থেকে সবচেযে বেশি এবং গুরুত্বসহকারে যারা নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন তারা আমাদের যুবরা। তারা আর কেউ নয় তারা আমাদের ছেলে-মেয়ে-ভাই-বোন আত্নীয ও পরিজন আমাদের প্রতিবেশি আমাদের দেশের সন্তান। তারা কোন বেতনভুক্ত কর্মচারী নয় যে তার অফিস থেকে আদেশ দিবে, অনেক বাধ্যবাধকতা আছে সেগুলো পালন করতে হবে। তারা মনে করেন, এটি আমার দেশ। দেশের সকলে আমরা ভাই ভাই। কারো কোন বিপদ হলে আগে আমাদের ঝাপিয়ে পড়তে হবে। এটা যেন আমাদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এজন্য নিরলসভাবে মানুষের পাশে থেকে নানানভাবে সেবা করে যাচ্ছেন।
আমাদের বাংলাদেশে চলতি বছরের মার্চ মাসে করোনা শনাক্ত রোগী পাওয়া গেছে। আর সেদিন থেকে আমাদের যুবরা মাঠে নেমে পড়েছে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় নিজ নিজ উদ্যোগে মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন। এই করোনা এমন একটি অদৃশ্য ভাইরাস যার নাম শুনে এবং সংক্রমিত এর মাত্রা দেখে দেশের প্রতিটি মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। যুবরা কিছু না ভেবে মাঠে নেমে পড়েছে করোনা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করার জন্য। দেশের বিভিন্ন এলাকার মতো উপকূলীয় এলাকার যুবরাও পিছিয়ে নেই। বিশেষ করে শ্যামনগর উপজেলার যুব টিম সিডিও ও সুন্দরন স্টুড্টে সলিডারিটি টিমের সদস্যরা।তারা এ মহামারী করোনার শুরু থেকে উপকূলীয় এলাকায় মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরির জন্য হ্যান্ডবিল বিতরণ, বিভিন্ন পোস্টার টানানো ও বিতরন, মৌখিক সর্তকতা, বিদেশ এবং দেশের অন্য এলাকা থেকে আসা ব্যক্তিদের হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিৎকরণ এবং হাতে সিল মারা, জীবাণুনাশক স্প্রে করা, চাঁদা উঠিয়ে এবং নিজেদের অর্থায়নে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় খাদ্য বিতরণ করা, সাবান ও মাস্ক বিতরণ, দোকানগুলোতে দুরত্ব বজায় রাখার জন্য নিশানা করা, বিভিন্ন গ্রামে লকডাউন করা, ইট ভাটার শ্রমিকদের তালিকা তৈরি করে আলাদা সাইক্লোন সেল্টারে নিয়ে যাওযা, বিভিন্ন মোড় ও মসজিদে সাবান দিয়ে হাত ধোওযার ব্যবস্থা করা, অসুস্থ্ রোগীকে রক্ত প্রদান, বাজার ও স্ট্যান্ডগুলো ভিড় হচ্ছে কিনা তা দেখা, স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনের সাথে করণীয় বিষয়ে প্রতিনিয়ত আলোচনা করাসহ নানান ধরনের কাজ চলমান রেখেছেন এই যুবরা।
আর এ করোনা মহামারী চলাকালীন সমযে উপকূলীয় এলাকা দিয়ে আবার ঘূর্ণিঝড় আমফান আঘাত হানে। এতে করে উপকূলীয় এলাকায় বিশেষ করে খুলনার কয়রা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলায় ব্যাপক ক্ষযক্ষতি হয়। উপকূলের বাঁধ ভেঙে হাজার হাজার বিঘা চিংড়ি ঘের, শত শত পুকুর, বসতভিটা, সবজি ক্ষেত, বিভিন্ন ধরনের গাছ গাছালি, সুপেয় পানির পুকুর ও পিএসএফ, লেট্রিন, ঘর বাড়িতে লবণ পানি ঢুকে পড়ে। অনেকের ঘরও ভেঙে গেছে। কয়েকদিন ধরে নদীর লবণ পানির জোয়ার ভাটা বইতে শুরু করেছে। এ প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগে এবং পরে কিন্তু আমাদের যুবরা বসে ছিলো না।তারা ঘূর্ণিঝড় আমফানের পূর্ব মুহুর্ত নানান ধরনের প্রচার চালিয়েছেন। রাত দিন ধরে মানুষ, গবাদি পশু পাখি, আসবাবপত্র, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে নিরাপদে স্থানে নিয়ে যাওয়াসহ স্থানীয় সরকার ও জনগোষ্ঠীর সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখেছেন তারা। এছাড়াও ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সময়েও এলাকায় কোথায় কি সমস্যা হয়েছে কিভাবে তা সমাধান করা যাবে তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন। ঘূর্ণিঝড় আগ থেকে বর্তমান সময় পর্য়ন্ত তারা এখনো তাদের কাজ ও সেবা চলমান রেখেছেন। কখনো নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া, খাবার ব্যবস্থা করা, ঘরের চালের ও রাস্তার উপরের ডাল কেটে দেওয়া, কারো ঘর সংস্কার করে দেওয়া, সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা, ভাঙন কবলিত স্থানে বাঁধ নির্মানে সহায়তা করা, পানির পাত্র ও পানি শোধন ট্যাবলেট সহায়তা সহ প্রতিনিয়ত খোঁজ খবর নেওয়া ইত্যাদি কাজ এখনও তারা করছেন।
একদিকে মহামারী করোনা ভাইরাস অন্যদিকে উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় আমফানে মানুষের জীবন জীবিকা যেন এক হতাশার মধ্যে দিয়ে চলেছে। আর সেই মুহুর্তে যুবদের এ সহায়তা ও পাশে থাকা, তাদের সহায়তা কিছুটা হলেও মানুষের মধ্যে কিছুটা হেলেও স্বস্তি এনে দিযেছে। এবিষয়ে শ্যামনগর উপজেলার কল্যাণপুর গ্রামের জেলে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা কল্যাণপুর, মানিকপুর, চিংড়াখালী, ও সৈয়দালিপুর গ্রামের প্রায় ১৫০ উপরে জেলে পরিবার আছি। সকলেই প্রায় মাদার নদীর চরে খাস জায়গায় আমাদের বসবাস। এই করোনা কালে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করতে না পারায় সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এর নিকট বারবার সহায়তা চেযেও ব্যর্থ হয়েছিলাম। এরপর যুব টিমের সহাযতায় করোনাকালে যে খাদ্য সহায়তা পেয়েছি তা যে কি উপকার হযেছে তা বলার মতো নয়। আমরা আমাদের এ যুবদেরকে কোন দিন ভূলবো না।’
ঘূর্ণিঝড় আমফান ক্ষতিগ্রস্ত পূর্ব দূর্গাবাটি গ্রামের স্থানীয় যুব, প্রবীণ ব্যক্তি ও নারীরা বলেন, ‘আমরা যে এলাকায় বাস করি সেখানে প্রতিনিয়ত নানান ধরনের দূর্যোগ মোকাবেলা করে টিকে আছি। আমাদের চারপাশে শুধু পানি আর পানি। যেদিকে তাকাই সেদিকে শূধু পানি ।এ দুর্যোগে নদীর বাঁধ ভেঙে আমাদের সুপেয় পানির যে উৎস্গুলো ছিলো তা নষ্ট হয়ে গেছে। এতে করে আমাদের সুপেয় পানির সংকট দেখা দেওয়া শুরু করেছে। দু’একদিন খাবার না খেয়ে থাকা যায় কিন্তু পানি না হলে চলে না। সেখানে দূর্যোগের পরের দিন থেকে যুবরা নানানভাবে আমাদের পানি দিয়ে সহায়তা করে যাচ্ছে এবং এখনো তা চলমান রেখেছেন। তাদের এ পানির সহায়তা না পেলে এলাকায় নানান ধরনের রোগ ব্যাধি শুরু হয়ে যেতো। এই যুবদের কল্যাণে আমরা তা থেকে রেহায় পাচ্ছি। এ সংকটকালীন মূহুর্তে আমরা যুবদেরকে আমাদের পাশে পেয়েছি এটা আমাদের অনেক বড় পাওয়া।’
দাতিনাখালী বনজীবী নারী শেফালী বেগম বলেন, ‘সেই করোনার শুরু থেকে এবং এই ঘূর্ণিঝড়ের আগে থেকে যুবরা নানানভাবে আমাদের সহায়তা করছে। যেটা আমাদের নিজের সন্তানেরা যেমনভাবে নিজের বসতভিটা নিজের পিতামাতকে আগলে রাখে ঠিক তেমনভাবে তারা আমাদের পাশে থেকেছেন। আমাদের এ বাঁধ রক্ষা এবং বাঁধ নির্মাণের জন্য তারা নিজেরা শ্রম দিয়েছে তেমনি এলাকার মানুষকে কাজে লাগিয়েছেন। তাদের অনুপ্রেরণায় আমরা সকলে কাজে ঝাপিয়ে পড়ার সাহস পেয়েছি।’
করোনা ও ঘূর্ণিঝড় আমফান এই দুর্যোগে যুব টিম কেন সক্রিয়ভাবে মানুষের কল্যাণে এগিয়ে এসেছে সেই বিষয়ে একটি যুব সংগঠনের প্রতিষ্টাতা গাজী আল ইমরান বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকায় একটা যুব বিপ্লব ঘটবে এমনটি আমি আশা করেছিলাম। যেখানে যুবরা নিঃস্বার্থভাবে মানুষের পাশে থাকবে। মানুষকে সেবা করবে মানুষের ভালো মন্দ বুঝবে। এলাকা ও দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে এটাই আমাদের চাওয়া ছিলো। সেখানে যুবরা রাতদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে টিমকে একটি স্থানে নিযে গেছে। করোনা মহামারী এবং আমফান দুর্যোগে যুবরা যেভাবে মাঠে ঝাপিয়ে পড়েছেন, মানুষের পাশে থেকেছেন সেটা অনেক বড় পাওয়া। আজ তাদের কাজ দেখে শতশত যুবরা অগ্রহী ও উদ্যোগী হচ্ছে। আমরা এভাবে মানুষের পাশে থাকতে চাই।’ আর যতটুকু করছি তার স্বীকৃতি হলেই আমরা সফল।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি যুব সংগঠনের সভাপতি মারুফ হোসেন মিলন বলেন, ‘আমরা যুবরা সংগঠিত হযে ২০০৯ সাল থেকে স্বেচ্ছায় এলাকার উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের পথ প্রদর্শক ছিলো বারসিক। তাদের দেখানো পথেই আমাদের পথচলা। আজ এলাকায় অনেক ধরনের যুব টিম তৈরি হচ্ছে, মানুষের সেবা করছে সেটা খুবই ভালো। বিগত সময়ে যতো রকমের দুর্যোগ এসেছে আমরা যুবরা আগেই সেখানে ঝাপিয়ে পড়েছি। এই করোনা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমরা মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। নিজেদের সব বিপদ ও বাধা অত্তিক্রম করে আমরা আমাদের কাজ চালু রেখেছি।বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিয়ে আমাদের একাজ চলমান রয়েছে। ভবিষ্যতেই যেকোন দুর্যোগ আসলে আমরা যুবরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করবো।’
যুবসমাজ হল একটি সমাজের চালিকাশক্তি। বাঙালি বীরের জাতি। আমরা মায়ের ভাষা কেড়ে নেয়ার নাগপাশ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছি। স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার হাত থেকে জাতিকে উদ্ধার করেছি। আর এসব কর্মকাণ্ডে সবার আগে প্রাণ দিয়েছে তরুণ ও যুব সমাজ। তেমনিভাবে যেকোন দুর্যোগ হলে আগেই আমাদের যুবরা এগিয়ে আসে। করোনা ও ঘূর্ণিঝড় আমফান যুবরা যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে তা কোন প্রতিষ্ঠান কোন প্রকল্প নিয়ে কাজ করলে কোটি কোটি টাকা লাগতো। সেখানে যুবরা নিজেদের স্বার্খ ত্যাগ করে দেশ ও দশের কল্যাণে যেভাবে ঝাপিয়ে পড়েছে তা সত্যিকার অর্থে ভুলে যাবার নয়।