পৌষের রোদমাখা সেই দিনগুলো – – –
আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর (মানিকগঞ্জ) ॥
সকালের এক টুকরো রোদ্দুর/ এক টুকরো সোনার চেয়েও মনে হয় দামি।
ঘর ছেড়ে আমরা এদিক ওদিকে যাই/ এক টুকরো রোদ্দুরের তৃষ্ণায়।
কবি সুকান্ত লিখেছিলেন, পৌষের রোদমাখা মিষ্টি সকালের এমন লোভনীয় বর্ণনা। তবে আধুনিকতার ধ্বকলে ধীরে ধীরে বিলীনের তলানীতে মিশে যাচ্ছে পরিবেশ আর প্রকৃতির রূপরেখা। আর সময়ের ব্যস্ততায় হারিয়ে যাচ্ছে শৈশবের গল্পমালার সেই সুখস্মৃতি। ক্রমশই যেন ভুলে যাচ্ছি মনের গহীনে সযতনে লালিত পৌষের রোদমাখা সেই দিনগুলোর কথা। যা ফিরে আর আসবে কি কখনো?
পৌষে প্রকৃতিজুড়ে শুরু হয় রঙ-বেরঙের খেলা। প্রান্তরজুড়ে সরিষার ক্ষেতে দোল খাওয়া কাঁচা হলুদ। সরিষার সবুজ গাছের হলুদ ফুল পৌষের সোনাঝরা রোদে ঝিকমিকিয়ে উঠছে। এ এক অপরূপ সৌন্দর্য। যেন প্রকৃতি কন্যা সেজে আছে “গায়ে হলুদ বরণ সাজে”। আশ্চর্য সুন্দরে আটকে যায় চোখ। খেজুরের রসে ভরে ওঠে মাটির কলসি। ম ম গন্ধ ছড়ায়। মাঝে মাঝে ছলকে আসা উত্তরে হিমেল হাওয়ায় কাঁপন ধরে আমলকীর বনে। গায়ে চাদর মুড়িয়ে পৌষের সকালে মিষ্টি রোদে জ্বাল দেয়া খেজুর রস আর হাতে ভাজার মুড়ি মেলবন্ধন সবারই মনে সৃষ্টি করে এক নস্টালজিক আবেশ। উঠোনে বসে মিষ্টি রোদের আদর খেতে কার না ভালো লাগে? “পৌষের কাছাকাছি রোদমাখা সেইদিন” গানটা অজান্তেই ঘুরপাক খায় মনের মাঝে। কিন্তু সেই দিন কি ফিরে আসবে আর কোনোদিন?
পৌষে ফুলেরাও যেন বাড়তি আবেদন নিয়ে হাজির হয়। সৌন্দর্য্যরে সবটুকু মেলে ধরে। মৌসুমী ফুলে ভরে ওঠে বাগান। হলুদ গাঁদা ফুল এরই মাঝে শীতকে স্বাগত জানিয়েছে। গোলাপ সারাবছরই ফোটে। তবে এখন মৌসুম। ফুটছে ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, মোরগফুল। মুখ তুলে তাকাচ্ছে সূর্যমুখী।
শীতের বিশেষ ফল কমলালেবু। তারও আগে বলতে হয় (কুল) বড়ইয়ের কথা। শীতের জনপ্রিয় ফল কুল। কুল নানা জাতের হয়। যেমন নারকেল কুল, আপেল কুল, বাউ কুল ইত্যাদি। সব কূলই উপকারী। ফোঁড়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, হৃদরোগ, প্রদর, রক্ত আমাশায়, মাথাব্যথা ইত্যাদি সমস্যা কুল, কুলের পাতা, ছাল সমাধান করতে পারে। এছাড়াও আপেল, সফেদা, ডালিমসহ নানা মজার মজার ফল পাওয়া যায় শীতকালে। এসব ফলের যে শুধু স্বাদ চমৎকার তা নয়, রয়েছে অনেক গুণাগুণও।
পৌষের প্রকৃতি বড়ই অদ্ভুত। মাঝে মাঝেই হয় রূপের পালাবদল। সূর্যালোকের দেখা মেলে না। ঘন কুয়াশায় ঢাকা থাকে চারপাশ। রাতে শিশির ঝরে বৃষ্টির মতো। প্রকৃতির এ রূপ বর্ণনা করেই জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন- শিশির পড়িতেছিল ধীরে-ধীরে খ’সে;/ নিমের শাখার থেকে একাকীতম কে পাখি নামি/ উড়ে গেলো কুয়াশায়,-কুয়াশার থেকে দূর-কুয়াশায় আরো।
“পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসি খুশীতে বিষম খেয়ে/ আরও উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে। বাংলাদেশের বিখ্যাত কবি বেগম সুফিয়া কামাল শীতের পিঠাকে নিয়ে এমন বর্ণনা লিখেছেন পল্লী মায়ের কোল কবিতায়। পৌষে কৃষকের ফসল ঘরে তোলার কাজ শেষ হয়ে যায়। হাতে তেমন কাজ থাকে না। সবাই উৎসব-আনন্দে মাতে। নতুন ধান থেকে পাওয়া চালে ঘরে ঘরে চলে পিঠা পুলির আয়োজন। পৌষের শেষদিনে ব্যাপক আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় পৌষসংক্রান্তি।
পৌষের এই পিঠা উৎসবকে কেন্দ্র করে বাড়ি বাড়ি মহাধুম পড়ে যেতো। গ্রামের প্রায় প্রতি বাড়িতে আসতো জামাই-ঝি, নতুন কুটুম আর বিয়াই-বিয়াইনসহ আত্মীয়স্বজন এবং দূরদূরান্তে অবস্থান করা পরিবারের সদস্যরা। আগের মতো গাঁও-প্রামে বাড়ি বাড়ি এখন আর পিঠা উৎসব হয় না। ঘিওরের রাথুরা গ্রামের জাহেরা বেগম বলেন, “শীতের পিঠা খাওয়াতে মেয়ে ও জামাইদের দাওয়াত করে এনেছি। ছেলে সপরিবারে থাকে গাজীপুরে। তাদেরও ফোন করে বাড়িতে এনেছি। বছরের একটি দিন সবাই মিলে পিঠা পায়েশ না খেলে মন ভরে না।”
পরিবেশ রক্ষা নেত্রী লক্ষ্মী চ্যাটার্জ্জী জানান, আমাদের দেশে পৌষ মাস মানেই বাঙালির পিঠা-পুলির উৎসব। বাঙালির শেকড়ের আদি ঐতিহ্য। শীতের পিঠার গোড়াপত্তন গ্রামে। একটা সময় শীতের পিঠার জন্য শহর থেকে গ্রামে যাওয়ার রেওয়াজ ছিল। গ্রাম-বাংলার সেই রসাল পিঠা-পায়েস আর পরিবারের সবাই মিলে সে পিঠা খাওয়ার উৎসব রীতি এখন অনেকটাই ম্লান। বাড়ির আঙিনায় মাটির চুলার ওপর মাটির হাঁড়িতে পিঠা বানানোর যে দৃশ্য, তা এখন আর সহসা চোখে পড়ে না।
নদ-নদী, হাওড় ও জলাধারে ঘুরে বেড়ায় শীতের পাখিরা। প্রায় সারাদেশের বনে, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের শাখায় চলে পাখিদের মহোৎসব। দেশীয় পাখিদের সঙ্গে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে যোগ দেয় অতিথি পাখিরা। বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী একটি উৎসব ঘুড়ি ওড়ানো। জানা যায়, মুঘল আমল থেকেই বাংলাদেশে এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। পৌষের বিকেলে ছেলেবুড়ো সবারই পছন্দ ঘুড়ি ওড়ানো।
আমাদের প্রায় সবারই আদি শেকড় গ্রামে। গ্রামীণ পরিবেশে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে শীতকাল। দিন যায়; দিন আসে। বয়স বাড়ে; ফুরিয়ে আসে শৈশবের কত স্মৃতি। আমরা ইচ্ছে করলেও এখন পারি না শীতে ঘাসের চূড়ায় চূড়ায় ঝলমলানি শিশির বিন্দু স্পর্শ করতে। দেখা হয়না দিগন্ত বিস্তৃত সরিষা ফুলে সোনা রোদের মাখামাখি। ভোরবেলায় বাড়ির উঠোনে গাছির হাতে টাটকা খেজুর রসের আস্বাদন নেই না কতদিন! সকালে শিউলি ঝরা মাঠে অথবা শিশির ভেজা দূর্বা ঘাসের উপর খালি পায়ে ছুটে চলা হয়না বহুদিন। সময়ের ব্যস্ততা আর আধুনিকতার ধ্বকলে ধীরে ধীরে বিলীনের তলানীতে মিশে যাচ্ছে শৈশবের গল্পমালার সুখস্মৃতি। আমাদের মনের গহীনে সযতনে লালিত পৌষের রোদমাখা সেই দিনগুলোর কথা।