আমারও জানতে ইচ্ছে করে
বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে শহিদুল ইসলাম
‘আমি টোকাই!’ লোকে আমাকে টোকাই এবং পিচ্ছি কইরাই ডাকে। সারাদিন বা কখনো দিনে অর্ধেক ভাগ শহরের বিভিন্ন জায়গায়, নর্দমায় ঘুরে ঘুরে কাগজ প্লাসটিক কুড়াই। বিক্রি করি । এগুলো বিক্রি করে কোনদিন ত্রিশ টাকা আবার কোন দিন সর্বোচ্চ হলে একশত থেকে দেড়শত টাকা পাই। স্কুলে যাইতে পারিনা সবসময়। আমার মন চায় ওদের (যারা স্বচ্ছল ও মা-বাবা যত্ন করে তেমন শিশু) মতো বাবার সাথে মায়ের সাথে ঘুরে বেড়াই, বাগান দেখি, যাদুঘর দেখি, আমারো জানতে ইচ্ছা করে।’ উপরোক্ত কথাগুলো বলেছিলো রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের নামোভদ্রা বস্তিতে বসবাসকারি শিশু ইমন।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, শহরজুড়েই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রায় একই অবস্থা। তাদের ইচ্ছাগুলো শোনার, জানার মানুষের বড়ো অভাব। আমরা উন্নত হচ্ছি। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। সবকিছুতেই নাকি উন্নয়নের ছোঁয়া লাগছে। কিন্তু বস্তির সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা সবসময় কেন যেন তাদের স্বপ্নগুলো পূরণে তাদের মতো করে সহযোগিতা পাচ্ছেনা। এদিকটাতে নজর দেয়া ভীষণ দরকার আমাদের। শিশুরা দিনে দিনে ঝুকিপুর্ণ পেশার সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। বস্তির মধ্যে শিশুশ্রমের কারণে তারা শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। আবার দেখা যায় অল্প বয়সেই এই শিশুরা নোংরা আবর্জনার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য কুড়ানোর কাজের সাথে জড়িত হবার কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। স্কুলের পরিবেশটাও যেন তার মতো না হয়ে উঠার কারণে স্কুলে গিয়েও পরে আবার ঝরে পড়ছে। এসবের মূল কারণগুলো খোঁজা দরকার।
শিশুর বাবা মায়ের বা অভিভাবকের আয় রোজগারের দিকটাও বোঝা দরকার। অনেক সময় বাবা মা অভাবের কারণে বা অসচেতনতার শিশুকে শিশুশ্রম বা ঝুঁকিপর্ণ পেশার সাথে জড়িত করছে বাধ্য হয়ে। আবার শিশু নিজের পেটের খুদা নিবারণে অনেকসময় ‘টোকাই’র কাজ করে কিছু টাকা আয় করে পেটের আহার সংগ্রহ করছে। সবকিছুকেই গুরুত্ব দিয়ে আমাদের ভাবা দরকার। আমরা যারা উন্নয়নের দিকগুলো নিয়ে কাজ করছি। বিশেষ করে সরকারি প্রতিষ্ঠান এই দিকগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে সমন্বিতভাবে বস্তির উন্নয়নে কাজ করা দরকার। সরকারি বেসরকারি সকলের পাশাপাশি নাগরিক সমাজসহ সকলের নজর দেয়া দরকার।
বিভিন্ন সংগঠনের পাশাপশি রাজশাহীর কিছু তরুণ শিক্ষার্থী বিষয়গুলোতে নজর দিয়েছেন। শহরের বিভিন্ন বস্তির শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ তাদের মননশীল উন্নয়নে নানা ধরনের কার্যক্রম হাতে নিচ্ছে। শিশুদের নিজের এলাকার ইতিহাস ঐতিহ্য এবং বৈচিত্র্য বিষয়ে সম্যক ধারণা দিতে তারা শিশুদের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী এবং প্রত্নতত্ত্ব এলাকা পরিদর্শনের উদ্যোগ গ্রহণ করছেন। যার ধারবাহিকতায় প্রথম পর্যায়ে তরুণদের স্বেচ্ছাশ্রমে গড়া সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য ‘স্বপ্ন পুরণ স্কুল’ গতকাল আয়োজন করেছিলো ‘এসো জানি ইতিহাস-ঐতিহ্যের বরেন্দ্র’। এতে রাজশাহী শহরের বস্তির প্রায় ৫০ জন শিশু রাজশাহীতে অবস্থিত বরেন্দ্র যাদুঘরে রক্ষিত বিভিন্ন প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং বৈচিত্র্য বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেন। মূলত সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও বৈচিত্র্য বিষয়ে জ্ঞানার্জনই ছিলো উদ্দেশ্য।
সুবিধাবঞ্চিত এসব শিশূ শহরের বাসিন্দা হয়েও কখনো এখানে প্রবেশ করতে পারেনি তথ্যের অভাবে, একজন অবিভাবকের অভাবে। আজ সেটিই পূরণ করলো রাজশাহীর তরুণ সংগঠন স্বপ্ন পুরণ স্কুল। সংগঠনটির সভাপতি তরুণ ডা. আবিদ হোসেন বলেন, ‘আমরা নিজের লেখাপড়া এবং কাজের পাশাপাশি বস্তির শিশুদের স্কুলগামীসহ তাদের বিভিন্ন দিকগুলো উন্নয়নে কাজ করছি। যাতে তারা এই সমাজের একজন মননশীল সুন্দর মানুষ হয়। দক্ষ হয়ে দেশের একজন সম্পদে পরিনত হয়।’
উল্লেখ্য, স্বপ্ন পুরণ স্কুলটি রাজশাহীর ৫নং ওয়ার্ডে অবস্থিত। এখানে রাজশাহীর কিছু স্বেচ্ছাসেবী তরুণ বস্তির সুবিদাবঞ্চিত শিশুদের নিয়মিত শিক্ষাদান করা হয়। শিশুদের স্কুলগামী করা হয়।