করোনায় ভয় নয়, সম্মিলিত উদ্যোগে করবো জয়
নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
বড় এক কঠিন সময় পার করছে পৃথিবীর মানুষ। মহামারী করোনায় গতিময় এই পৃথিবীর হঠাৎ করে থেমে যাওয়ায় দুনিয়ার সকল মানুষের কাছেই এক কঠিন অভিজ্ঞতা। দ্রুত সংক্রমিত করোনা ভাইরাস মাত্র তিন থেকে চারা মাসের মধ্যে সারা দুনিয়ায় বিস্তৃত হয়েছে। এখন পর্যন্ত যাকে মোকাবেলা করার মত চিকিৎসা পদ্ধতি না থাকায় ইতোমধ্যে প্রাণ গেছে দুই লক্ষ্যের অধিক মানুষের, আক্রান্ত হয়েছে প্রায় তিন মিলিয়ন মানুষ। এই পরিস্থিতিতে এই সংক্রমন থেকে অন্যদের নিরাপদ রাখার জন্য একমাত্র পন্থা হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টিকে। যেখানে স্বাস্থ্যবিধি হিসেবে মানুষ থেকে মানুষের সামাজিক দূরত্ব তথা তিন থেকে ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখা নিশ্চিত করতে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ ও অঞ্চল সেই দেশের অভ্যন্তরে সমগ্র দেশে বা অঞ্চলকে ঘোষণা করছে লকডাউন এলাকা হিসেবে। মানুষ যে যেখানে আছে সেখানেই অবস্থান করবে, যেন অন্যদের দ্বারা এই ভাইরাসে সে নিজে সংক্রমিত না হয় বা অন্যদের সংক্রমিত না করে তা নিশ্চিত করতে। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের সরকারও কোন ধরনের প্রস্তুতি ছাড়াই ও দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ঝঁকি থাকা সত্বেও এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। সকল দেশের মত এদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র ও গণমাধ্যম ব্যাপকভাবে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে দেশের মানুষকে ঘরে থাকার জন্য। কিন্তু শত প্রচেষ্টার পরেও মানুষকে ঘরে আটকিয়ে রাখা যাচ্ছে না, নানা প্রয়োজন ও অপ্রয়োজনে মানুষ বেরিয়ে আসছে ঘর থেকে, বাড়িয়ে তুলছে সংক্রমনের ঝুঁকি। এই পরিস্থিতিতে মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ সহযোগিতার মাধ্যমে মানুষকে ঘরে রাখার প্রচেষ্টায় এগিয়ে এসেছে নেত্রকোনা সম্মিলিত যুব সমাজ।
প্রাথমিকভাবে এলাকার আগ্রহী ও উদ্যোগি ব্যক্তিদের সহযোগিতায় নেত্রকোনা সম্মিলিত যুব সমাজের সদস্যরা যতটা সম্ভব নিজেদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে নগরের নিন্ম আয়ের মানুষ তথা রিক্সা চালক, অটোচালক, রাজমিস্ত্রী, হরিজন, কুলি, মুচি, দিনমজুর প্রভৃতি পেশার মানুষদের খাদ্য উপহার দেয়। এর পাশাপাশি সংক্রমন মোকাবেলায় নিজেদের তৈরি হ্যান্ড সেনিটাইজার, মাক্স, বিতরণ করে। সেই সাথে ব্লিচিং পাওডার, জীবানুনাশক স্প্রে দিয়ে নগরের অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ ও অপরিচ্ছন্ন এই এলাকায় পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার উদ্যোগ গ্রহণ করে। নগরের মধ্যবিত্ত পরিবার গুলো যারা লোক লজ্জার ভয়ে কোথায় হাত পেতে ত্রাণ বা সহায়তা নিতে পারছেনা তাদের রাতের অন্ধকারে চাল, ডাল, তেল, লবণের মতো নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌছে দিতে সম্মলিত যুব সমাজের যুবরা চালু করেছে হট লাইন নম্বর। মোবাইলে খবর পেয়ে রাতের অন্ধকারে সাইকেলে চড়ে খাবার পৌচ্ছে দিচ্ছে তারা।
এছাড়াও নেত্রকোনা জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের বাজার, পাড়া মহল্লায় করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত জনসচেতনতা তৈরিতে লিফলেট বিতরণ, হাত ধোয়া, মাক্স ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি বিষয়ে প্রচারণা চালায়। সেই সাথে সরকারি প্রনোদনায় কোন কোন পরিবারগুলোকে কি ধরনের সহযোগিতা করা যেতে পারে সেই বিষয়ে তালিকা প্রণয়নে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানকে নানাভাবে সহযোগিতা করে স্থানীয় প্রান্তিক মানুষদের সরকারের বিভিন্ন সহযোগিতা পেতে সহায়তা করে আসছে। যেন এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় নগর বা গ্রামের প্রান্তিক মানুষগুলোকে স্থানীয় সুদকারবারী মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ গ্রহণ করে নিঃস্ব না হতে হয়।
সংগঠনের সদস্যরা নেত্রকোনা জেলার সদর, আটপাড়া, কেন্দুয়া, মদন, কলমাকান্দা, দূর্গাপুর প্রভৃতি উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের কৃষকদের ধান কেটে দেয়ার পাশিপাশি বাড়ির চারপাশে গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালীন সবজি চাষে নানাভাবে সহযোগিতা করে আসছে। এই পরিস্থিতে বাজার থেকে বীজ সংগ্রহ করতে না পারার কারনে কৃষিকাজে বীজর এক ধরনের সংকট রয়েছে। এই সংকট মোকাবেলায় বারসিক’র সহযোগিতা বিভিন্ন গ্রামে যেসব গ্রামভিত্তিক বীজঘর ও বীজ বিনিময় কেন্দ্র রয়েছে সেই কেন্দ্র থেকে পারস্পরিক পারস্পারিক বীজ বিনিময়ের মাধ্যমে চাষকৃত জমি ছাড়াও বাড়ির চার পাশে সবজি চাষে গ্রামীণ নারীদের উব্দুদ্ধ করছে এই এলাকার যুব ও কৃষক সংগঠনগুলো। তাদের এই পুরো কর্মপ্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে নেত্রকোনা সম্মিলিত যুব সমাজ এলাকায় মানুষের দুশ্চিন্তা ও উদ্বিগ্নতা কমিয়ে সচেতনতা ও সাহস বাড়াতে একটি বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছে। করোনায় তোমরা ভয় পেওনা, তোমাদের নিরাপত্তায় সরকার, প্রশাসনের পাশাপাশি আমরা যুবসমাজও রয়েছে তোমাদেরই পাশে।
উল্লেখ্য ২০১০ সালের দিকে বারসিক নেত্রকোনা জেলার বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে স্কুল পর্যায়ে পরিবেশ বিষয়ে তরুণ প্রজন্মকে সচেতনতার জন্য গঠন করা হয় স্টুডেন্ট সলিডারিটি টিম। সময়ের ধারাবাহিকতায় সেই টিমের সদস্যরাই এলাকার পরিবেশ উন্নয়নসহ সমাজে পরিবর্তনে সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণের তাগিদ থেকেই এলাকাভিত্তিকভাবে গড়ে তোলে বিভিন্ন যুব সংগঠন। আর এসব যুব সংগঠনের সম্মিলিত রূপটিই হচ্ছে নেত্রকোনা সম্মিরিত যুব সমাজ। স্কুল পর্যায়ে সবুজ পৃথিবী গড়ার শপথ নিয়ে যাদের যাত্রা শুরু সেই তরুণরা নানা প্রতিবন্ধকতার মাঝেও যে তারা তাদের স্বপ্নময় পথচলা থেকে সরে আসেনি, করোনা মহামারীর মত সংকটময় পরিস্থিতিতে মানুষকে শক্তি ও সাহস যোগানোয় গৃহীত প্রচেষ্টাগুলোই তার উজ্জল দৃষ্টান্ত।