করোনায় কেমন আছে শিল-কাটার শিল্পী মতিয়ার রহমান
সাতক্ষীরার, শ্যামনগর থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
অতীতে আমাদের গ্রাম এলাকায় প্রতি সপ্তাহে প্রতিমাসে ‘শিলকাটাও শিলকাটাও’ বলে এরকম শব্দ শোনা যেত। আর তা হলো শিল কাটনিওয়ালা পাথর কেটে তার উপর সুন্দর করে খোদায় করে দিতো, যা আমাদের রান্না ঘরের কাজে বেশি ব্যবহৃত হয। বিভিন্ন ধরনের মসলা বাটতে, চাল বাটতে, ডাল বাটা সহ নানান ধরনের কাজে। আস্তে আস্তে এ পেশাটি হারিয়ে যেতে বসেছে। তার পরও কিছু কিছু মানুষ আমাদের পুরাতন ঐতিহ্য সেসব পেশাকে আগলে রেখেছেন। তা দিয়ে তাঁরা পরিবারের আয়ের পথ খুঁজেন। ঠিক তেমনি একজন মানুষ হলন সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার নুরনগর ইউনিয়নের নুরনগর গ্রামের প্রবীন মতিয়ার রহমান (৭৬)। অতীতের মতো তিনি এখনও সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে গিয়ে শিল কাটা, নোড়া কাটা ও গৃহস্থালী যন্ত্রপাতি দা, কুড়াল, কদাল ছুড়িতে সান/ধার দেওয়ার কাজ করে চলেছেন্।
মতিয়ার রহমানের ২ ছেলে। তারা এখন সবাই আলাদা থাকেন। প্রায় ১৮ বছর ধরে তিনি এ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এই বয়সে কেন এই কাজ করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ কাজটি করতে আমার ভালো লাগে। বিভিন্ন স্থানে যেতে পারি বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলতে পারি। আর শিলের গায়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে খোদাই করে আলাদা একটু শান্তি পাই। যে কারণে এই বয়সে আমার আয়ের জন্য এ পথটিকে সঠিক এবং উৎকৃষ্ট বলে আমি মনে করি। আর এই কাজটি করে কোন রকমে আমাদের সংসার চলে যায়। কোন কোন সময় আমি এ কাজ করতে বাইরে ৪-৫ দিন থাকতাম। এছাড়াও দিনে কোন না কোনদিন যেসব বাড়িতে কাজ করতাম তারা দুপরে খেতে দিতেন। কিন্তু এই দিনটা যেন হারিয়ে যেতে বসেছে।’
কারণ হিসাবে তিনি বলেন, ‘বর্তমান সময়ে যে সারা বিশ্ব করোনা করোনা করে পাগল হয়ে যাচ্ছে। আর এতে করে আমরা যেসব পেশাজীবীরা পেটের টানে খাদ্য যোগান দেওয়ার জন্য বাইরে বের হই তারাই বিপদে পড়েছি। একদিন কাজ না করলেই আমাদের সংসার চলে না। আর এখন তো সব বন্ধ। যদিওবা হাট বাজার, দোকান পাট, ব্যাংকসহ সব ধরনের অফিস ছোট আকারেও খুলছে। কিন্তু আমাদের তাতে কি? আমরা কাজের জন্য বাইরে যাচ্ছি ঠিকই কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি যে শিল কাটার কাজ করি। এ কাজে আগে মোটে না হোক দিনে ৩০০ টাকার উপরে আয় না করে বাড়ি আসতাম না। আর এখন মানুষের দুয়ারে দুয়ায়ে ‘শিলকাটাও শিলকাটাও, দা বটিতে ধার দেবেন নাই’ এরকম চিৎকার করলেও মানুষ যেন আর ডাক শুনছেনা। আগের যেসব পরিচিত বাড়ি ছিলো সেসব বাড়িতে আগে হরহামেশেই ঢুকতে পারতাম কিন্তু এখন গেলে নানান ধরনের প্রশ্ন কেন আসলেন? দেশের কি অবস্থা? তা কি জানেন না? আমাদের বাড়িতে এখন আর ঢুকবেন না। এরকম নানান ধরনের প্রশ্ন শুনতে হচ্ছে। আগে যেসব বাড়িতে কাজে গেলে একবেলা একমুঠো খেতে দিতো তারাই এখন তাদের বাড়িতে যেতে নিষেধ করেন। এখন সারা দিন কাজ করে গ্রামে গ্রামে ঘুরেও ১০০ টাকাও জোগাড় করা যেন খুবই কষ্টকর হয়ে পড়েছে।’
মতিয়ার রহমান জানান, তাঁর বয়স হয়েছে। তারপরও নিজের পেশাকে টিকিয়ে রাখা এবং সংসারের কথা মাথায় রেখে বাইরে বের হচ্ছেন। কিন্তু তাতে কিছু হচ্ছে না। যে শান দেওয়ার কাজ করেন সেটাও নষ্ট হয়ে গেছে, নতুন করে একটা শান কেনা দরকার তাও কিনতে পারছেন না।ঘরের মধ্যে পানি পড়ছে নিজেদেরে পোশাকও ক্রয় করতে পারছেন না। এই করোনা এসে তাদের বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। একদিকে করোনা অন্যদিকে বর্ষাকালের বর্ষা। আবার এখনকার মানুষ যেন আর আগের মতো এসব জিনিস ব্যবহার করেন না। এখন নানান ধরনের ইলেকট্রনিক্স জিনিসের ব্যবহার করছেন তারা।তিনি আরও জানান, সব রকমের প্রাকৃতিক দুর্য়োগ মোকাবেলা করতে পারতেন তারা কিন্তু এই করোনা দুর্যোগ মোকাবেলা করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে তাঁরা শুধু পিছনের দিকে যাচ্ছেন সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার যেন কোন রাস্তা খুঁজে পাচ্ছেন না। করোনা তাদের জীবন-জীবিকা আটকে দিয়েছে! আটকে দিয়েছে তাদের পেশার কাজকে।
বর্তমান সময়ে যেমন আমাদের অনেক ঐতিহ্যবাহী পেশা ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে। অনেকে পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় চলে গেছেন। আবার কিছু কিছু পেশা এখনো টিকে আছে। তবে নানান সময়ে নানান ধরনের দূর্য়োগের কারণে মানুষের পেশা বিলুপ্ত হচ্ছে। নানা ধরনের দুর্য়োগের সাথে বর্তমান সময়ে মহামারী করোনা সারা বিশ্বের মানুষকে পিছিয়ে দিয়েছে। এ পিছিয়ে পড়ার মধ্যে সব থেকে এগিয়ে আমাদের পেশাজীবী জনগোষ্ঠী। যারা প্রতিনিয়ত তাদের নিজেদের প্রয়োজনে কাজের সন্ধানে বাইরে বের হলেও সঠিকভাবে মিলছে না তাদের কাজ। এতে করে তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। হঠাৎ করে নতুন পেশায় যোগ দিতে পারছেনা বা মানিয়ে নিতে পারছেনা। সেরকম আমাদের শিল কাটা মতিযার রহমানের মতো অনেকেই করোনা দুর্য়োগের মধ্যে নানান ধরনের সমস্যার মধ্যে দিন অতিবাহিত করছেন। তাই এই করোনা মহামারীকালে পেশাজীবী জনগোষ্ঠীর পেশা টিকিয়ে রাখতে সুশীল সমাজ, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সহায়তা দরকার।