আলামিন মিয়ার কৃষি বাড়ি
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
তাঁর বিশাল সবুজ ভুবনে হাজারো গাছের চারা দক্ষিণা বাতাসে দোল খেয়ে খেয়ে এক মনোরম দৃশ্যের সুষ্টি করে, যা দেখে গ্রামের মানুষের মন ভরে উঠে। সবুজের সমারোহ ও প্রাণবৈচিত্র্যসমৃদ্ধ নগুয়া গ্রামের আলামিন মিয়ার এই বাড়িটিকে ‘কৃষিবাড়ি’ হিসেবে নির্বাচন করা হয়।
কৃষিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে এবং প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় অক্লান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছেন কেন্দুয়া উপজেলার আশুজিয়া ইউনিয়নের নগুয়া গ্রামের কৃষক আলামিন মিয়া। আলামিন মিয়া বয়স ৩৫। মা-বাবা, স্ত্রী, একটি মেয়ে এবং দুই ভাই ও এক বোন নিয়ে আলামিন এর ৭ সদস্যের সংসার। পিতামাতার প্রথম সন্তান তিনি। দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে পিতার সাথে কৃষি কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন। আলামিন মিয়া মূল পেশা কৃষি এবং কৃষির সকল উপকরণই তার পরিবারে রয়েছে। যেমন: মই, লাঙ্গল, জোয়াল, বিন্দা, দা, কাচি, শাবল, খুনতি, গরু, ছাগল,হাঁস-মুরগি, পুকুরে মাছ, বৈচিত্র্যময় শস্য ফসলের বীজ।
বসতঘরেই আলামিন গড়ে তুলেছেন বীজঘর। তিনি সারাবছর স্থানীয় জাতের ধান, সরিষা, মসলা, মাসকলাই, সীম, মরিচ, লাউ, কুমড়া, শসা, মিষ্টিকুমড়া, পুইঁশাক, ঢেড়শ, মূলা, ডাটাসহ নানা জাতের শস্য ফসলের বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ করেন। আলামিন মিয়া তার সংরক্ষতি বীজ গ্রামের কৃষক-কৃষানী ছাড়াও অন্য গ্রামের কৃষক-কৃষাণীদের মাঝে বিতরণ ও বিনিময় করেন। নিজের কাছে কোন জাতের বীজ না থাকলে অন্য কৃষকদের থেকে বীজ নিয়ে এসে চাষ করেন। তিনি হাইব্রিড ধান ও হাইব্রিড জাতের সবজি ফসল চাষ করেন না। তিনি বাড়ির সামনে ৫০ শতাংশ জমিতে বছরব্যাপী বৈচিত্র্যময় ফসল যেমন: মরিচ, পেয়াজ, রসুন, ধনিয়া, ডাটা, মূলা, মিষ্টিআলু, গোলআলু, সীম, লাউ ইত্যাদি ফসল চাষ করেন। জমিতে মাঁচা তৈরি করে এসব ফসল তিনি চাষ করেন। তার মাঁচাতে সারাবছর কোননা কোন সবজি থাকে। বাড়ির উঠানে তিনি পাঁচ জাতের মরিচ চাষ করেছেন, যেমন: কালো মরিচ, সাদা মরিচ, উবদা মরিচ, গোল মরিচ, আঙ্গুর মরিচ। সারাবছর তিনি কাঁচা মরিচ বিক্রি করেন এবং গ্রামের সবাই তার বাড়ী থেকে মরিচ নিয়ে যায়।
আলামিন মিয়ার রয়েছে ২০টি হাসঁ, ৮০টি মুরগি, ৫টি ছাগল, ৬টি গরু ও ৫ জোড়া কবুতুর। তিনি চলতি আমন ২০১৮ মৌসুমে স্থানীয় ৫ জাতের ধান চাষ করেছেন যেমন: লতিশাইল, মালা, কালোজিরা, বাদশাভোগ, চিনিশাইল। চাষকৃত প্রত্যেক জাতের ফসলের বীজ তিনি সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করেন। আলামিন কেঁচো সার তৈরি করে তা দিয়ে সবজি চাষ করেন, সবজি চাষে তিনি কোন রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করেন না। জৈব উপায়ে চাষ করায় এলাকায় তার সবজির কদর বেশি, বাড়ি থেকে লোকজন সবজি কিনে নিয়ে যায়। বাজারের চেয়ে তুলনামূলক কম মূল্যে তিনি সবজি বিক্রি করেন। বাড়ির চারপাশে প্রায় সব ধরণের ফলের গাছ রয়েছে যেমন- আম, কাঁঠাল, জাম, জাম্বরা, পেয়ারা, লিচু, জলপাই, কামরাঙ্গা, আমড়া, সুপারি, নারিকেল, পান গাছ ইত্যাদি। ফলের গাছ ছাড়াও বিভিন্ন ধরণের ঔষধি গাছ যেমন: সাজনা, নিম, হরিতকি, তুলসী, বহেরা, শিমূল।
বাড়ির সামনে ১৫ শতাংশের পুকুরে আলামিন মিয়া স্থানীয় বৈচিত্র্যময় জাতের মাছ যেমন- রুই, মৃগেল, কাতলা, স্বরপুটি, পুটি, মলা, শিং, কৈ, সিলভারকার্প, গ্রাসকার্প ইত্যাদি মাছ চাষ করেন। লবণ ছাড়া আলামিনকে বাজার থেকে কোন কিছু কিনতে হয় না। কৃষি ফসল ও গবাদী পশু-পাখি পালনের আয় দিয়ে তার ৭ সদস্যের পরিবার খুব ভালোভাবেই চলে যায়। উৎপাদিত বীজ নিজ গ্রাম এবং অন্য গ্রামের কৃষকদের সাথে বিনিময়ের ফলে সকলের নিকট তিনি খুবই পরিচিত ও প্রশংসনীয়। কৃষি ফসল চাষাবাদ ও গবাদী পশু-পাখি পালনে তার এই দক্ষতাকে তিনি নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। কেঁচো কম্পোষ্ট ও জৈব সার উৎপাদন ও ব্যবহারের জন্য তিনি নিজ গ্রামের কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করেন। তার চাষাবাদ পদ্ধতি সম্পর্কে উদ্ধুদ্ধ হয়ে নগুয়া গ্রামের ৮ জন কৃষকও একই পদ্ধতিতে তাদের পতিত জমিতে সবজি চাষ করছেন এবং তারাও নিজ নিজ বাড়িকে প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর এক একটি কৃষিবাড়ি হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছেন। আলামিন গ্রামের সকল কৃষকদের পরিবেশবান্ধব কৃষি ফসল চাষাবাদের সাথে যুক্ত করার অঙ্গীকার করেছেন। নগুয়া গ্রামকে কীটনাশকমুক্ত একটি কৃষি গ্রাম হিসাবে দেখার প্রত্যয়ে কৃষক আলামিন মিয়া কাজ করে চলেছেন।
আলামিন মিয়ার এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। আলামিন মিয়ার মত কৃষকরাই পারেন কৃষি প্রাণবৈচিত্র্য বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে। আলামিনের এই উদ্যোগ একদিকে যেমন কৃষি ফসলের এবং গবাদী পশু-পাখির বৈচিত্র্য বৃদ্ধি করেছে, তেমনি সাধারণ মানুষকে বিষমুক্ত নিরাপদ খাদ্যের যোগান সুনিশ্চিত করতে সক্ষম হচ্ছে। আলামিনের মত সকল কৃষক বৈচিত্রময় ফসল জৈব উপায়ে চাষ করলেই দেশের মানুষের জন্য নিরাপদ ও বৈচিত্র্যময় খাদ্য নিশ্চিত হবে। তাই সকল কৃষকদেরকে আলামিনের মত জৈব উপায়ে বৈচিত্র্যময় ফসল ও পরিবেশবান্ধব উপায়ে গবাদী পশু-পাখি পালনে এগিয়ে আসার আহবান জানাচ্ছি।