সুন্দরবনে নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিলেন বনজীবী সুপদ মন্ডল
শ্যামনগর সাতক্ষীরা থেকে শেখ তানজির আহমেদ::
[su_slider source=”media: 135,134,133″]
সুপদ মন্ডল। থাকেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবন সংলগ্ন বুড়িগোয়ালিনী ব্যারাকে। আইলায় মুন্সীগঞ্জের বাঘদী পাড়ার পিতৃভিটা হারিয়ে নৌবাহিনী নির্মিত এই ব্যারাকে ঠাই হয় তার। ৭৬ বছর বয়সী সুপদ মন্ডল সেই ৮ বছর বয়সে বাবার নৌকায় সুন্দরবনে যাওয়া শুরু করেন। জীবনের এই দীর্ঘ সময়ে বনের নদী-নালায় মাছ ধরে ও মধু কেটেই জীবন চলেছে তার। সংসার নির্বাহের তাগিদে সুন্দরবনে যান এখনো।
আপন মনে নিজ নৌকা ও জাল নিয়ে যান বাদায়। জঙ্গলে গিয়ে স্ব-চোখে দেখেছেন বাঘ-শুয়োরের লড়াই। বনের রাজা রয়েল বেঙ্গলের থাবায় হারিয়েছেন সঙ্গীকে। একজন আপদমস্তক বনজীবী হিসেবে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল ও উপকূলীয় মানুষের বন নির্ভর জীবনযাত্রার নিত্য দিনের সঙ্গী তিনি।
বনজীবীদের বিশ্বাস, শক্তি ও সামর্থ্যরে উজ্জল দৃষ্টান্ত সুপদ মন্ডল জানান, সেই ৮ বছর বয়স থেকেই জঙ্গলের সাথে সম্পর্ক তার। তার মত অন্যান্যরাও বনবিবির পুজা করে বনে প্রবেশ করেন। জঙ্গলে কোন দুর্ঘটনায় পতিত হলে ১৮ ভাটি পথপাড়ি দিয়ে মা বনবিবি তাদের রক্ষা করেন বলে বিশ্বাস তাদের। একই বিশ্বাসে শুক্রবার বনে যান না বনজীবীরা। সুপদ মন্ডল বলেন, ‘ছোট বেলা একবার বনে গিয়ে বাঘে-শুয়োরে লড়াই দেখেছি। তিনদিন ধরে চলেছিল ওই লড়াই। তিন দিনের দিন শুয়োর বাঘের পেটে উকু মেরেছিল। আর তাতে বাঘের পেট থেকে গলা পর্যন্ত চিরে গেল। আর শুয়োরের দাঁত পড়ে গেল। আমি ওই দাঁত নিয়ে আইছিলাম।
বেশ আক্ষেপ করেই তিনি বলেন, “বন তো নেই। পাখি বসবে কোথায়। আগে জঙ্গলে বড় বড় পাখি দেখেছি। বনে বড় বিলের কাক, রাজপক, শঙ্খল, মদন টাকসহ বিভিন্ন প্রজাতির শত শত পাখি দেখা যেত। কিন্তু এখন আর দেখা যায় না।” হেতাল বন ও গেওয়া ছাড়া বনে বড় কোন গাছ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বনের ভেতর ফাঁকা হয়ে গেছে। গাছ কেটে সাবাড় করে দেছে চোরেরা। আগে ধোদল, পশুর, বাইন, কেওড়া, জানা ও গর্জনসহ বড় বড় গাছ ছিল। গাছ না থাকলে পাখি থাকে? আগে অনেক পশু-পাখি ছিল, মোম-মধুও বেশি ছিল। এখন মোম মধু বসার জায়গাই নেই।
সুপদ মন্ডল জানান, আইলার পর আর বড় মাছ পাওয়া যায় না। আগে কাঠা বেলি, গণগণি, বেলে, দাতনে, ফেসা, ভেটকি, কাইন, পায়রা, টেপা, চান্দা, খয়রা, মেদ, ইলিশসহ বহু প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। তিনি বলেন, “আইলার সময় বৃষ্টিতে বড় বড় শিল পড়েছিল। সেই শিল খেয়ে বড় বড় মাছ মরে ভেসে উঠেছিল। এক মণ/দেড় মণ ওজনের মাছও পেয়েছি মরা। তারপর থেকে বড় মাছ এখন দেখাই যায় না।”
সুপদ মন্ডল জানালেন, তার দেখা মতে, সুন্দরবনে নদ-নদী আগের থেকে বড় হচ্ছে। পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন। দেশের অভ্যন্তরে যখন নদ-নদী শুকিয়ে হাহাকার অবস্থা তখন সুন্দরবন এলাকায় নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির ইঙ্গিত কি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ভবিষ্যৎ ও বহুল আলোচিত প্রভাব নির্দেশ করে? এখানে এ প্রশ্ন উঠতেই পারে।
এখন জঙ্গলে যাওয়া বেশ দুস্কর উল্লেখ করে সুপদ মন্ডল জানান, মুক্তিপণ ছাড়া এখন তো জঙ্গলে যাওয়াই যায় না। বনে চোর-ডাকাতির এতো উৎপাত কখনোই ছিল না। একবার তিনজন মিলে বনে উঠেছিলেন মধু কাটতে। তিনি ছিলেন গাছের উপরে। বাকি দু’জন নিচে। হঠাৎ বাঘে নিয়ে গেল তার এক সঙ্গীকে। সেবার যারপর নেই ভয় পেয়েছিলেন তিনি। বন থেকে ফিরেই এক আত্মীয়ের কাছ থেকে শিখেছিলেন সুন্দরবনে বাঘ বন্ধ করার বান, মন্ত্র ও গন্ডি। করতে পারেন পানিবন্ধও।
সুপদ মন্ডলের বিশ্বাস জঙ্গলে নামলে বাঘ তাকে ছুয়ে দেখবে না। অন্যান্য সঙ্গীদের রক্ষার জন্য তিনি বাঘ বন্ধ করে বনে নামেন। কামট-কুমিরের ভয়ে বন্ধ করে নেন পানিও। বনজীবীদের বিশ্বাস বাঘের চোখে একবার চোখ পড়লে মানুষের আয়ু ছয় মাস কমে যায়। বাঘের এক এক হাতায় ১৮ জন পুরুষ মানুষের শক্তি থাকে।
সুন্দরবনের ভেতর পাকা দালান, শান বাধানো পুকুরের কথা শুনলে অবাক হবেন যে কেউ। আর ঠিক এমনই এক কথা শোনালেন এই বনজীবী। বললেন, “দুই ভাটি পথ দূরে সুন্দরবনের ভেতরে রয়েছে রাজা প্রতাপাদিত্যের সময়কালের বড় বড় পাকা দালান, ভালো শান বাঁধানো পুকুর। কেউ সেখানে থাকে না। তারপরও রাতে সেখানে শোনা যায় ঝাড়, শঙ্খের ধ্বনি, উলু দেন মহিলারা।
বিজয় সরকারের ভক্ত সুপদ মন্ডল শুনালেন একটি গানও। প্রথমে একটু লজ্জা পেলেও গেয়ে উঠলেন, ‘পিছে পড়ে যায় যদি দয়াল…………… আমায় সঙ্গে নিও।’
সুন্দরবন না বাঁচলে উপকূলীয় জীবন-জীবিকা রক্ষা করা যাবে না বলে মনে করেন তিনি। আর এ জন্য নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি আগে বদলাতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সুন্দরবন না বাঁচলে আমরা বাঁচবো না। আমরাই তো আমাদের রক্ষক সুন্দরবনকে ধ্বংস করছি।