আমাদের সম্পদ ফিরিয়ে পেয়েছি
সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
প্রকৃতির মূলে আছে বীজ, বীজেই সৃষ্টি। বীজ ছাড়া কোন কিছু চাষাবাদ করা যায় না। কৃষি ও কৃষকের শক্তি হলো বীজ। বীজ যেন প্রত্যেক কৃষকের কাছে তার সন্তানের মতো। পিতামাতা যেমন তার সন্তানকে লালল পালন করেন। প্রকৃত কৃষক ঠিক তেমনিভাবে বীজকে লালন পালন করেন। আমাদের কৃষি মূলভিত্তি যখনই বীজ তখন বীজ তো সম্পদ। আর এ সম্পদেকে টিকিয়ে রাখা প্রত্যেকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ বীজ ভালো হলেই তো ভালো আর তা না হলে কৃষককে চোখের জল ফেলতেই হয়।
আমরা জানি উপকূলীয় এলাকায় একসময় প্রত্যেকটি বাড়ি ছিলো এক একটি কৃষি বাড়ি। আর এসকল বাড়িতে নানান ধরনের প্রানবৈচিত্র্যে ভরা ছিলো। প্রত্যেক বাড়ির বাইরের দৃশ্য দেখলে বোঝা যেতো যে বাড়িতে কি কি আছে। প্রত্যেকেই মৌসুমভিত্তিক বিভিন্ন ধরনরে ফসল চাষাবাদ হতো এবং পরবর্তী বছরের জন্য বীজ সংরক্ষণ রাখতো। এটাই যেনো কৃষকে নিত্যনৈমিত্ত ব্যাপার ছিলো। সময়ে পরিক্রমায় যতই দিন বদলাতে শুরু করেছে ততই যেনো পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। বিভিন্ন ধরনের কোম্পানির আগ্রাসন সাথে প্রাকৃতিক বিভিন্ন ধরনরে দুর্যোগের কারণে কৃষক তার নিজের সংরক্ষতি বীজ হারাচ্ছে।
আর আমরা জানি বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল হলো দুর্যোগ ঝুকিপূর্ণ এলাকা। এখানে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেনো লেগেই আছে। আর শত প্রতিকূলতার মধ্যে উপকূলীয় মানুষ তাদের নিজেদের জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাত হানে। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সময়ে মাঠ পর্যবেক্ষণে, সংগঠন ও গ্রাম পর্যায়ে বিভিন্ন সময়ে আলোচনার মাধ্যমে জানা যায়, এসময় উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি হয় বসতঘর, ল্যাট্রিন,গাছ-গাছালী, মৎস্য ঘের, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন ধরনরে সম্পদ ধান ও সবজির ক্ষেত, বাড়ির আঙিনা তছনছ হয়ে গেছে। সাথে সুপেয় পানির পুকুর, পিএসএফ, যাতায়াত রাস্তা, বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন সহ নানান ধরনের ক্ষয় ক্ষতির সন্মূখিন হতে হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের গ্রাম ও সংগঠনে স্থানীয়দের সাথে আলোচনায় তাদের বীজ সংকটের কথা তুলে ধরেন। তারা বলেন, ‘আমরা গরমের সবজি শেষ হওয়ার সাথে সাথে আমরা শীত মৌসুমের জন্য ক্ষেত প্রস্তুত করেছিলাম, অনেক ক্ষেতে গরমের সবজিও ছিলো; সাথে ক্ষেতে ধানও ছিলো। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে সবজি চাষের ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর এর জন্য আমাদের সামনের মৌসুমের জন্য সবজি বীজ দরকার।’
এ প্রসঙ্গে শংকরকাটি গ্রামের কৃষাণী নাজমা বেগম বলেন, ‘আমরা সব রকমের বীজ সংরক্ষণ রাখতাম। এ ঘূর্ণিঝড় হওয়াতে আমরা বীজ হারিয়ে ফেলেছি সেক্ষেত্রে আমরা আবার বীজ পেলে পরবর্তী মৌসুমের জন্য বীজ সংরক্ষণ রাখতে পারবো।’ অন্য নারী চন্দনা চক্রবর্তী বলেন, ‘আমার নিজের তেমন জায়গা জমি নেই অন্যের ৩ বিঘা জমি লিজ নিয়ে সবজি চাষ করি। এবছর আমার অনেক সমস্যা তৈরি হলো যে ক্ষতি হয়েছে তা কিভাবে পূরণ করবো তা চিন্তা করতে পারছিনা। আমাদের এখন বীজের দরকার।’ এভাবে শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন বিভিন্ন গ্রাম থেকে বীজের চাহিদা দেন স্থানীয় জনগোষ্ঠীরা।
তাদের চাহিদার ভিত্তিকে কর্মএলাকার বীজ সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত হয়। সে লক্ষে সম্প্রতি শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ি ইউনিয়নের কাশিমাড়ি, কাঠালবাড়ি, জয়নগর গ্রামে, ভুরুলিয়া ইউনিয়নের কাচড়াহাটি গ্রামে, শ্যামনগর সদরের কালমেঘা, বাদঘাটা, ইসমাইলপুর, গোপালপুর, জাওয়াখালী গ্রামে, ইশ^রীপুর ইউনিয়নের গুমানতলী, বংশিপুর, কেওড়াতলী গ্রামে, গাবুরা ইউনিয়নের চকবারা গ্রামে, কৈখালী ইউনিয়নের জয়াখালী গ্রামে, রমজাননগর ইউনিয়ন রমজাননগর, চাদখালী ও মানিকখালী গ্রামে, পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পাখিমারা, সোনাখালী, চন্ডিপুর, খুটিকাটা গ্রামে,মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের জেলেখালী, কুলতলী, সিংহরতলী, মথুরাপুর গ্রামে, বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের বুড়িগোয়ালিনী, পানখালী ও দাতিনাখালী গ্রাম, নুরনগর ইউনিয়নের রামজীবনপুর গ্রামসহ মোট ১২টি ইউনিয়ন ৩০টি গ্রামে ৮০০ পরিবারের মাঝে ১২ প্রকার বীজ (লালশাক, পালনশাক, মুলা, গাজর,মিস্টিকুমড়া, লাউ, টকপালন, আলু, ধনিয়া, মৌরি, সরিষা ও খেসারী ডাল বীজ )সহায়তা করা হয়।
বীজ গ্রহণকারী নারী শেফালী বেগম বলেন, ‘এ বীজ সহায়তা পেয়ে আমাদের অনেক উপকার হয়েছে। যেন আমরা আমাদের সম্পদ ফিরিয়ে পেয়েছি। আমরা যে বীজ হারিয়েছি এ বীজ থেকে সেসব বীজ তৈরি করতে পারবো। পরবর্তীতে আমরা এ বীজ সংরক্ষণের পাশাপাশি অন্যদের সহযোগিতা করতে পারবো। এতে এক ধরনের সম্পর্ক তৈরি হবে সকলের মধ্যে।’
এভাবে নিজেরা নিজেদের বীজ সংরক্ষণের পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে পারিস্পারিক সম্পর্ক উন্নয়নসহ সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে। প্রতিটি এলাকায় প্রত্যেক মানুষের কাছে তাদের বীজ সম্পদ টিকে থাকবে এ প্রত্যাশা করি।