সমাজ উন্নয়নে নিভা রাণীর উদ্যোগ
নেত্রকোনা থেকে পাবর্তী সিংহ
মনের মাধুরী দিয়ে এক খন্ড মাটিকে কোন একটি শৈল্পিক রূপ দিয়ে যারা মনের ভাব প্রকাশ করে। যাদের হাতের স্পর্শে তৈরি হয় আমাদের পরিবেশবান্ধব নিত্য প্রয়োজনীয় আসবাপত্র অথবা ঘর সাজানোর উপকরণ যেমন হাড়ি, পাতিল, ঢাকনা, পুতুল, ইত্যাদি। তাঁরাই হলেন আমাদের বাঙালির ঐহিহ্যবহনকারী কুমার সম্প্রদায়। বংশ পরম্পরায় পূঁজিবাদী প্রতিযোগিতার বাজারে উন্নত প্রযুক্তির যুগে দ্রারিদ্রতার সাথে সংগ্রাম করে আজও তারা রক্ষা করে চলেছেন পূর্বপুরুষের পেশা।
সমাজে তারা মাথা উচুঁ করে দাঁড়াতে পারে না। আধুনিকতার ধারায় অতি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে আমাদের জীবনমান, অভ্যাস, নিত্য প্রয়োজনীয় আসবাবের আদল, রঙ, স্থায়িত্ব। সেগুলো পরিবেশবান্ধব না হলেও সুলভ। আমাদের দেশে এখন আর কদর নেই কুমারদের। এই প্রতিকূল পরিবেশে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন নিভা রানী। প্লাস্টিক, পলিথিন, স্টিলের রাজ্য থেকে নিজেদের পেশার ঐতিহ্যকে রক্ষা, সমাজে নিজেদের সম্মানের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করতে তার উদ্যোগ অনেকের কাছে অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।
পরিবারে একজন দায়িত্বশীল জননী
নিজের পরিবারের অসচ্ছলতা, সমাজে অবেহলিত হওয়ায় এবং মেয়ে হওয়ার কারণে খুব একটা লেখাপড়া করা হয়ে ওঠেনি নিভা রানীর। পরিবারের কাছ থেকে পুঁথিগত বিদ্যা না পেলেও শৈল্পিক শিক্ষা এবং সমাজে একত্রে থাকার মনমানসিকতা অন্তরে ধারণ করতে পেরেছেন। বিয়ের পর তিনি এখন কুমার পরিবারে ৬ সন্তানের জননী। কুমার পরিবারে জন্ম হওয়ায় পরিবার থেকে পাওয়া শৈল্পিক শিক্ষা বিবাহিত জীবনের জীবিকায়নের পথকে কিছুটা সুগম করে। স্বামীর সাথে সাথে মাটির উপকরণ তৈরি করে সহযোগিতা করেন। সন্তানদের ভরণ-পোষণ, লেখাপড়া, বিয়ে, এসব কাজে অর্থনৈতিক অবদান কম নয় তার।
একজন দক্ষ সংগঠক
বাঙালির ঐতিহ্যকে ধরে রাখার প্রয়াসে এবং জীবিকার তাগিদে মেলায় অংশগ্রহণকালে পরিচয় হয় “জাল-নদী মাছ” সংগঠনের প্রধানের সাথে। এই সূত্র ধরে একদিন “হাত বাশঁ দা” হাবাদা সংগঠনের কার্যক্রম পরিদর্শন করেন নিভা রানী। সংগঠনের সদস্যদের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার ক্ষেত্রটি তার খুব ভালো লাগে। পরবর্তীতে নিজ গ্রামের ১০-১৫টি কুমার পরিবারের সাথে আলোচনা করে তাদের একত্রে কাজ করার জন্য একটি সাংগঠনিক কাঠমো গড়ে তোলেন। নিজেদের পেশার গুরুত্ব বাড়াতে, প্রতিযোগিতার বাজারে নিজেদের টিকিয়ে রাখা, ভবিষ্যত প্রজন্মকে হীনমন্যতার জীবনযাপন থেকে মুক্তি দিতে, সমাজে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে গ্রামের সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহবান জানান তিনি। তার আহবানে সাড়া দেয় ৩০টি কুমার পরিবার। ৩০টি পরিবারের নারীদের নিয়ে তিনি গড়ে তুলেন “মাটিই জীবন কুমার নারী” নামে একটি সংগঠন। প্রাথামিক পর্যায়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম যেমন-নারী স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মৃৎ শিল্প উপকরণের মান উন্নয়নে বিভিন্ন রকমের কার্যক্রম শুরু করে। পরবর্তীতে ভবিষ্যৎতের জন্য একে অন্যের পাশে দাঁড়ানোর সৎ ইচ্ছায় ৫ টাকা করে সঞ্চয় শুরু করেন। প্রতিমাসে জমানো সঞ্চয় সংগঠনের নামে জমা করেন ব্যাংকে। নিভা রানী বলেন, “এই যামানায় হগলে এক থাহাই বল আর মনে শক্তি থাহে।”
একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ পেশাজীবী নিভা রাণী
প্রতিযোগিতার বাজারে প্লাস্টিক, স্টিলের উপকরণের সুলভ মূল্যের প্রভাব পড়েছে মাটির উপকরণের ওপর। তাদের কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে উপকরণ তৈরির কাঁচামাল। তবুও হাল ছাড়েনি নিভা রানী। বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছেন উপকরণ তৈরীর কৌশল, ডিজাইন সম্পর্কে জানার জন্য। আস্তে আস্তে বদলে দিয়েছেন উপকরণের রঙ, ডিজাইন, কৌশল এবং ধরণ। তাছাড়া নিজের সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে সকলকে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন।
শিক্ষা প্রসারে নিভা রাণীর অবদান
ভবিষ্যত প্রজন্মকে আলোকিত শৈল্পিক জীবন দিতে গড়ে তুলেছেন শিশু বিকাশ কেন্দ্র। মাটির কাজের শিক্ষা এবং পুথিঁগত বিদ্যা দিয়ে গড়ে তুলেছেন নতুন পথের সারথীদেরকে।