সুন্দরবন আবারো বাঁচালো স্বদেশ
ঢাকা থেকে পাভেল পার্থ:
সিডরের পর সুন্দরবন থেকে ফিরে একটা লেখা লিখেছিলাম। ‘বীর সুন্দরবন: জীবন দিয়ে বাঁচালো স্বদেশ’। ২০০৭ সনের ২০ নভেম্বর দৈনিক সমকালে লেখাটি ছাপা হয়। এরপর আপদবিপদ ও ঝুঁকি মোকাবেলায় অরণ্যের ভূমিকা আরো গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করেছি। কেবল বন নয়, জলাভূমি কি কৃষিজমিনসহ সকল বাস্তসংস্থানই আমাদের ঝুঁকিসমূহ সামাল দিয়ে চলে জীবন দিয়ে। সিডরের পর আজ আবার ১৩ বছর পর সেই একই ফরিয়াদ আবারো লিখছি। আবারো ঘূর্ণিঝড় আম্ফান থেকে দেশকে বাঁচাতে সুন্দরবনই নিজের জীবন দিয়ে লড়েছে ২০ মে সারারাত। কেবল সিডর বা আম্ফান নয়, আইলা কি মহাসেন, ফণী কি বুলবুলেও সুন্দরবনই ছিল উপকূলের সুরক্ষাপ্রহরী। কিন্তু প্রজাতি হিসেবে মানুষ এমনই স্মৃতিবিমুখ যে, বাদাবনের এই বীরগাঁথা কিছুদিনের ভেতর বেমালুম ভুলে যায়। একের পর এক জাহাজ ডুবে তেল কী রাসায়নিক ছড়িয়ে বনে সুন্দরবনে। কোনো বিচার নাই। একের পর এক বিনাশী উন্নয়ন প্রকল্পে দম আটকে আসে বাদাবনের। দিনে দিনে কমতে থাকে বাঘের পরিসংখ্যান। অথচ সুন্দরবনের চারধারে বাড়তে থাকে মানুষের বসতি আর কারখানা। বাঘের শরীর বিক্রি হয়ে যায় বহুজাতিক বাজারে আর বিশ্বসেরা ক্রিকেটাররা হরিণের চামড়ায় বসে বিয়ের কৃত্য সাজান। কোনো রা নেই। কেবল ঘূর্ণিঝড় এলেই আমরা হা করে চেয়ে থাকি রক্তলাগা এই বনের দিকে। করোনাকালে খাদ্যযোদ্ধা কৃষক যেমন আমাদের ক্ষুধা দূর করছেন, স্বাস্থ্যযোদ্ধারা যেমন চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন, পুলিশ যেমন নিরাপত্তা দিচ্ছেন তেমনি সুন্দরবনও প্রকৃতির যোদ্ধা হিসেবে সুরক্ষা দিয়ে চলেছে স্বদেশ। স্বাস্থ্যকর্মী, কৃষক, পুলিশের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছি। অনেকে হাততালি দিয়ে ধন্যবাদ জানাবার চল করেছেন। সুন্দরবনসহ দেশের প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থানের অবদানের প্রতি আমরা কী একটুখানি কৃতজ্ঞতা জানাতে পারি? করোনাকাল তো প্রমাণ করে চলেছে প্রাণ-প্রকৃতির কোনো বিকল্প নাই। এখানেই বিরাজিত আছে আমাদের সুরক্ষা ও বিপদমুক্ত হওয়ার সকল কারিগরি।
না জানি কত ক্ষত লেগেছে বাদাবনে
বাংলাদেশের মোট আয়তনের ৪.২ ভাগ এবং দেশের মোট বনভূমির ৪৪ ভাগ জুড়ে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের সুন্দরবন। স্থানীয়ভাবে বাদাবন, প্যারাবন হিসেবে পরিচিত দুনিয়ার সবচে’ বড় এই ম্যানগ্রোভ বনকে ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা-বিজ্ঞান ও সংস্থা ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে। বাংলাদেশ ২১ মে ১৯৯২ সালে সুন্দরবনকে দেশের প্রথম রামসার এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে। সুন্দরবনের ৬০১,৭০০ হেক্টর বনভূমি এই আন্তজার্তিক সনদের সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার অন্তর্ভূক্ত। বলেশ্বর, পশুরসহ প্রায় ৪৫০টি ছোট বড় নদ-নদীর প্লাবনভূমিতে গড়ে ওঠা এই বনের ৬০১৭ কি.মি এলাকায় ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৩৭৫ প্রজাতির প্রাণী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪১ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ২১০ প্রজাতির মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, ৪৩ প্রজাতির ঝিনুক সহ অগনিত প্রাণবৈচিত্র্যের সাথে স্থানীয় বাওয়ালী-মৌয়াল-মাঝি-জেলে-চুনরি-মুন্ডা-মাহাতো জনগণ গড়ে তুলেছে এক ঐতিহাসিক বাদাবন সংসার। সিডরে পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জের প্রায় ২ লাখ ৪৫ হাজার হেক্টর এবং পশ্চিম সুন্দরবনের ২০ হাজার হেক্টর এলাকা ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল। এরপর থেকে প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়েই আঘাত পেয়েছে সুন্দরবন। কিন্তু সেইসব ক্ষতের জনদলিলগুলো আমরা দেখতে পাইনি। আম্ফানে সুন্দরবনের কতটুকু এবং কী ধরণের ক্ষতি হয়েছে এবং এই ক্ষতি আগামীদেন কীভাবে সামাল দেয়া যায় তা এখনি আমাদের ঠিক করতে হবে।
চুরমার মধু মওসুম
সুন্দরবনে মধুমওসুম চলছে। খলসী, কেওড়া, গেওয়া, কাঁকড়া, বাইন একের পর এক ফুটতে থাকা ফুলের মধু সংগ্রহে ব্যস্ত মৌয়ালদের এবার খুব নিদান। করোনা সংকটে মধুসংগ্রহ ও বিক্রির বাজার অনিশ্চিত হয়েছে। আম্ফানে চাক ও মৌমাছির পরিবারে প্রভাব পড়বে। অনেক গাছ ক্ষতিগ্রস্থ হলে কেবল এবছর নয়, সামনের বছরও মধুমওসুম সংকটে পড়বে। মৌমাছি সংকটে পড়লে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরাগায়ণ প্রক্রিয়া রুদ্ধ হবে যা বনের গতিশীল বিকাশকে একটা প্রশ্নের মুখে ফেলবে। সুন্দরবনের নানান মধুর ভেতর আগুনে মৌমাছিদের(অঢ়রং ফড়ৎংধঃধ) চাকের পদ্মমধু স্বাদে ও গন্ধে সেরা। এটি খলসী ফুলের মধু। সিডরের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় খলসীসহ ব্যাপক বৃক্ষবৈচিত্র্য নিশ্চিহ্ন হয়েছিল বলে বন ও বনজীবীদের জীবনে পরের বছর গুলোতে এর প্রভাব লেগেছিল।
লবনের দাগ ও খাদ্যশৃংখল
সিডর থেকে বুলবুল একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত থেকে দেশকে বাঁচাতে সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান এবং খাদ্যশৃংখল চক্রেও পরিবর্তন ঘটছে। ঘূর্ণিঝড়ের জখম কাটিয়ে উঠতে সময় লাগছে। অনেক প্রাণীরই খাদ্যঘাটতি এবং বিচরণ সীমানার সংকট দেখা দিচ্ছে। জলোচ্ছ্বাসে বনের ভেতর মিঠা পানির সাথে লবন পানির মিশ্রন ঘটে যাওয়ায় বন্যপ্রাণীদের ক্ষেত্রে পানির সমস্যাও প্রকট হয়ে উঠবে। পানির লবন অনুপাতে হঠাৎ তারতম্য ঘটায় সংবেদনশীল জীবের ক্ষেত্রে ভিন্ন লবন ঘনত্বের সাথে খাপ খাওয়াতে সময় লাগবে। মাটির আর্দ্রতা, পুষ্টি ও ধরণে একধরনের পরিবর্তন আসবে। যা সুন্দরবনের উদ্ভিদ সংসারে বয়ে আনতে পারে দীর্ঘমেয়াদী দূর্ভোগ। প্রাকৃতিক পরাগায়ণ, বীজ বিসরন, জরায়ুজ অংকুরোদগম সহ উদ্ভিদ জীবনচক্রে তৈরী হবে ধীরগতির পরিবর্তনশীলতা। সুন্দরবনের গাছেরা তাদের বর্ষবলয়ে প্রমাণ রাখবে আম্ফানের স্মৃতি। সুন্দরবনের উদ্ভিদসমূহের বিশেষবৈশিষ্ট্য এর শুলো বা শ্বাসমূল, যা, ঘূর্ণিঝড়ের ভেতর নানান ভাবেই আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। এর আগের ঘূর্ণিঝড়ের অভিজ্ঞতায় দেখেছি সবচে’ ক্ষতি হয়েছে বনতলের। এবারো এরকম ঘটলে সহজাত অংকুরোদগমের মাধ্যমে প্রাকৃতিক বনবিস্তারে মুমূর্ষু বনতলকে লড়াই করতে হবে আরো প্রতিবন্ধকতার।
আমরা কতখানি বাদাবনের?
বনজীবীদের কাছে বাঘ হলো মা বনবিবির বাহন। বাঘ এক পবিত্র প্রাণসত্তা। সিডরের সময় শরণখোলাতে সন্ত্রস্ত একটি বাঘ স্থানীয় গ্রামে আশ্রয় নিলে বাঘটিকে কেউ উপদ্রব করেনি। বনের কোনো প্রাণসত্তা বিপদে পড়লে বনজীবীরা তাকে আবারো বাদাবনে ফিরিয়ে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। করোনাকার সময়েও শ্যামনগরে একটি হরিণ লোকালয়ে চলে এলে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয় বনে। বনজীবীরা তো আর বহুজাতিক বাঘ-বাণিজ্য চালু করেনি। সুন্দরবন নিয়ে সকল অপরিনামদর্শী উন্নয়নচিন্তা মূলত তৈরি হয়েছে তীব্র বাদাবনবিচ্ছিন্নতা থেকে। আমাদের চিন্তা করতে হবে আমরা এই বনের অংশ। কারণ প্রাণসম্পদ, পরিচয় কী সুরক্ষাবলয় কোনো না কোনোভাবে আমরা দুনিয়ার এই বৃহত্তম বাদাবনের সাথে জড়িয়ে আছি। এই বন না থাকলে কে আমাদের একের পর এক সুরক্ষা দিবে? আমাদের নিশ্চয়ই ১৯৯১ সনের জলোচ্ছ্বাসের কথা মনে আছে? মহেশখালীর মূলভূখন্ডকে সেসময় বাঁচিয়েছিল সোনাদিয়া ম্যানগ্রোভ বন। কিন্তু সেই বনকে আমরা আস্ত রাখিনি। ২০০২ সালের জুন মাসে স্থানীয় প্রভাবশালীরা সোনাদিয়ার বন প্যাট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে তৈরী করে বাণিজ্যিক চিংড়ি ঘের। যদিও পরিবেশ মন্ত্রনালয় এই এলাকাকে ১৯৯৯ সালে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা(ইসিএ) ঘোষণা করে। আমরা কি এমন কোনো শ্যামনগর, শরণখোলা, কয়রা, দাকোপ, মোংলা চিন্তা করতে পারি যেখানে বাদাবন নেই। আমরা কি সুন্দরবন ছাড়া বাংলাদেশ কী বিশ্ব কল্পনা করতে পারি? তাহলে এই বনের প্রতি আমাদের আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। এই বনের প্রাকৃতিক বিকাশকে নানভাবে সুরক্ষিত রাখতে হবে, এই বনই তো ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের একমাত্র সুরক্ষাপ্রহরী।
সমাধান আছে প্রকৃতির মাঝে
লেখাটি যখন লিখছি তার একদিন বাদেই ২২ মে। আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য দিবস। ১৯৯১২ সনে বিশ্ব ধরিত্রী সম্মেলনে আন্তজার্তিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদ ঘোষিত হয়। বাংলাদেশ এটি অনুমোদন ও স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশ ১৯৯৮ সনে এর অনুকূলে একটি খসড়া তৈরি করে এবং ২০১৭ সনে জীববৈচিত্র্য আইন চূড়ান্ত করে। প্রতিবছর প্রাণবৈচিত্র্য দিবসের জন্য একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়। করোনাকালে এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘প্রকৃতির মাঝেই আমাদের সকল কিছুর সমাধান’। করোনাকালে প্রকৃতির ভাষ্য বোঝার জন্য আমাদের নতজানু হওয়া জরুরি। পরনির্ভরশীল প্রজাতি হিসেবে এই দুনিয়ায় মানুষকে প্রকৃতির ওপর বাহাদুরি থামাতে হবে। সুন্দরবনকে সুরক্ষিত করার ভেতর দিয়ে এই চর্চা আমরা অব্যাহত রাখতে পারি। ঘূর্ণিঝড় আম্ফান আবারো এর জরুরিত্ব সারারাতভর ঝড়ের আওয়াজে আমাদের জানিয়ে দিয়ে গেলো।