এখনও মজুরি বৈষম্যের শিকার উপকূলীয় নারীরা
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডলঃ
একজন নারী সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত যে কতগুলো্ কাজ করে তা হিসাব করলে অনেক। আর সেসব কাজকে যদি টাকার অংকে হিসাব করা হয় তা কোন অংশে কোন চাকুরীজীবী মানুষের থেকে কম নয়। বিশেষ করে উপকূলীয় নারীরা তাদের যেমন দুর্যোগের সাথে এবং দুর্যোগ পরবর্তী পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে হচ্ছে। সুপেয় পানি সংগ্রহের জন্য লাইনের পর লাইন দাঁড়িয়ে পানি সংগ্রহ করতে হয়। নিজের ঘর সংসার দেখা। তারপর আবার কাজের জন্য বাইরে বের হওয়া হতে হয় তাদের। কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় কি আমরা সেটাকে কোনদিন মূল্যায়ন করেছি। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় আমরা নারীকে এক ঘরে করে রাখি। আমরা এটাই মনে করি যে, নারী শুধু ঘর, সংসার, ছেলে, মেয়ে মানুষ করবে। এটাই তার প্রধান কাজ।
কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন আমাদের নারীরা ঘর সংসার দেখাশুনা, ছেলে মেয়ের খেয়াল রাখার পাশাপশি বাইরে বের হচ্ছেন । নানান কাজের সাথে এখন তাদের যুক্ততা। পুরুষের চেয়ে কোন অংশেই কম নয় নারীরা। এখনো অনেক পরিবারে নারীরা প্রধান। আবার নারীকে সংসারের আয়ের একমাত্র উৎস হিসেবে দেখা যায়। নারীরা ঘর সংসার দেখার সাথে সাথে আয়ের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রেখে চলেছেন।
অনেক পরিবারে নারীরাই এখন সংসারের হাল ধরেছেন। আমরা যদি একটু দরিদ্র পরিবারের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো যে, শুধুমাত্র পুরষের আয়ে অনেক সংসার চলছে না। সেখানে নারীকে বাধ্য হয়ে পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু মজুরির বেলায় তারা বৈষম্যের শিকার হন। একজন নারী একজন পুরুষ সকালে একসাথে কাজ বের হচ্ছেন আবার একই সময় কাজ থেকে ফিরছেন। কাজও একই করছেন এবং সমান শ্রম ও সময় দিচ্ছেন। কিন্তু মজুরির বেলায় সবসময় অসমান। সেখানে পুরুষ বেশি পান; নারীরা কম পান। এ বৈষম্য উপকূলীয় এলাকায় বেশি দেখা যায়; যদিও সারা দেশে একই চিত্র!
উপকূলীয় এলাকার নারী ও পুরষের সাথে কথা হলে জানা যায়, এলাকায় পুকুর খননের কাজে একজন নারীকে দেওয়া হয় একবেলায় ১৮০ টাকা আর একজন পুরুষকে দেওয়া হয় ২৫০-৩০০ টাকা করে। চিংড়ি ঘেরের ঘাস ও ছেলা বাসতে গেলে ১৫০-১৮০ নারী পুরুষ ২৫০-৩০০ টাকা। আবার চিংড়ি ঘেরের রাস্তা সংস্কারে নারী ১৮০ পুরুষ ৩০০ টাকা। আবার বর্তমান সময়ে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা সফট কাঁকড়া ব্যবসা। সেসব কাঁকড়ার পয়েন্ট সেখানে নারীদের মাসে ৭০০০ পুরুষের ৮০০০ টাকা পান। বিলের জমিতে ধান লাগানো কাজে নারী ১৮০-২০০ পুরুষ ৩০০ টাকা পান। উপকূলীয় এলাকায় এরকম অনেক কাজেই এক ধরনের মজুরি বৈষম্য দেখা যায়। মুজরি বৈষম্য দূল করার জন্য বিভিন্ন সময়ে নানানভাবে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সভা, সেমিনারে, মানববন্ধনসহ কত কিছু না করা হলো কিন্তু তার কোন পরিবর্তন এখনোও আসেনি।
এ বিষয়ে ভুরুলিয়া ইউনিয়নের কাচড়াহাটি গ্রামের দিন মজুরী কৃষানী তরুলতা গায়েন বলেন ‘পুরুষ যে কাজ করে আমি ও তো সেই কাজ করি। টাকার বেলায় পার্থক্য। আমি মাসের প্রায় সময় সব রকমের যোন দিয়ে থাকি। এ কাজ করতে করতে আমার হাতে পায়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে যেমন ঘা পাচড়া, চুলকানি হয়েছে। তেমনি মনে হয় শরীরের রক্তও কালো হয়ে গেছে। আমরা তো কোন সহানুভূতি চাই না চাই; চাই আমাদের শ্রমের ন্যায্য মজুরি। আমরা যদি পুরুষের মতো সমান মজুরি পেতাম তাহলে আমাদের আর এ দুর্দশা থাকতো না। বুড়িগোয়ালিনী আশ্রয়ন প্রকল্পের নারী সুলতা রানী বলেন, আমাদের এ মজুরি বৈষম্য আমরা শুধু নারীরা কমাতে পারবো না। আমাদের পুরুষের সহায়তা দরকার। তারা যদি বলে যে আমাদের নারী ও পুরুষ সবার সমান মজুরী দিতে হবে। তাহলে মালিক কিন্তু ভেবে দেখবেন। কিন্তু পুরুষের তা করেনা। এ জন্য নারী পুরুষ উভই একত্রিত হয়ে আন্দোলন করলে হয়তোবা কোন একদিন আমরা সুফল পাবো।’
বুড়িগোযালিনী আশ্রযন প্রকল্পের রোহিত দাস সরদার বলেন, আমাদের এলাকায় এখন নারীদের কাজের অভাব নেই। পুরুষদের এলাকায় এখন আর তেমন কাজে নিতে চায় না। যার জন্য পুরুষেরা ইট ভাটা ও ধান কাটার কাজ বেশি করে। তার কারণ হলো এলাকায় যেসব মহাজন, ধনীলোক বা যেকোন লোক যেকোন কাজ করাতে গেলে আগে নারীদের খোঁজে। নারীদের কম মূল্যে নিতে পারে। একজনের পুরুষের টাকায় দুজন মহিলা যোন নিতে পারে। আবার কাজও বেশি হবে। তাই আমাদের নারীরা খুবই সমস্যার মধ্যে আছেন।
বাংলাদেশের জাতীয় নারী নীতিমালা ২০১১ এর ২৩.৭ উল্লেখ আছে যে, নারী-পুরুষ শ্রমিকদের সমান মজুরি, শ্রমবাজরে নারীর বর্ধিত অংশগ্রহণ ও কর্মস্থলে সমসুযোগ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং চাকুরীর ক্ষেত্রে বৈষম্য দুর করা। এর মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন হলেও মজুরির ক্ষেত্রে ব্যাপক ফারাক রয়ে গেছে। কবে যে হবে সে বিষয়ে কারও ধারণা যেন মাথাব্যথা নেই!