সাইফুল্লাহ’র মানবতা দর্শন
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে আল ইমরান
মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য। মানুষ তার জীবনে অনেক কিছুকে ভালোবাসে এবং সে অনেক কিছু নিয়ে স্বপ্ন দেখে। কিন্তু একটি ব্যতিক্রমধর্মী স্বপ্নের কথা জানালেন শ্যামনগর উপজেলার কালিন্দি নদীর কোলঘেঁষে অবস্থিত নৈকাঠি গ্রামের গ্রাম্য ডাক্তার মো. সাইফুল্লাহ। তিনি ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখেন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষদের (পাগল) জন্য আশ্রম তৈরি করবেন। এই স্বপ্নকে পূরণ করার জন্য সাইফুল্লাহ ইসলাম তার চলার পথে যেখান থেকেই মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ দেখেন সেখান থেকেই তাদের নিয়ে বাড়িতে আসেন। বাড়িতে নিয়ে আসার পর তিনি নিজ হাতে ওই মানুষগুলোর নখ ও চুল কাটেন, সবান মাখিয়ে গোসল করান এবং তাদের সাথেই খাওয়া দাওয়া করেন। এভাবে সাইফুল্লাহ এক পর্যায়ে মানসিক ভারসাম্যহী মানুষদের ভাষা, আকার, ইঙ্গিত-সব কিছুই বুঝতে পারেন।
সাইফুল্লাহ মানসিক ভারসাম্যহীদের সাথে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান। কোথাও দাওয়াত খেতে গেলে তিনি তাদের মধ্য থেকে এক দু’জনকে সাথে নিয়ে যান। এলাকার ভাড়া চালানো মটর সাইকেল ড্রাইভারদের বলে রেখেছেন কেউ পথে ঘাটে মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ পেলে যেন তাঁর কাছে নিয়ে আসা হয়। এজন্য তিনি বিনিময়ে একশ’ টাকা দেবেন ওই ব্যক্তিকে যিনি এসব মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ তাঁর বাসায় নিয়ে আসেন। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সাইফুল্লাহ তার এলাকায় রাতের বেলায় এক মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষকে দেখতে পেয়ে তার বাড়িতে নিয়ে আসেন। রাতে ওই ব্যক্তিকে খাওয়ান এবং নিজের ঘরেই থাকার জায়গা করে দেন। তাকে কিছুদিন চিকিৎসা করানোর পর লোকটি ভালো হতে শুরু করেন। দীর্ঘদিন সেবা করার পর ওই লোকটি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। লোকটি জানান তার বাড়ি ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলা। সাইফুল্ল্যাহ তাই ওই লোকটি নিয়ে ঢাকা নবাবগঞ্জে যান। দীর্ঘ সাত বছর পর ছেলেকে পেয়ে তার পিতা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। এলাকার হাজার হাজার মানুষ ওই লোকটির বাড়িতে হাজির হন এবং সাইফুল্লাহকে ধন্যবাদ জানান। মানসিক ভারসাম্যহীন লোকটির পিতা খুশি হয়ে সাইফুল ইসলামকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিলেও সাইফুল্লাহ সে টাকা গ্রহণ করেননি। তিনি বলেন, “মানুষ হিসেবে একজন মানুষকে সাহায্য করা আমার দায়িত্ব, ধর্ম।”
সাইফুল্লাহ বছরে দু’বার বিভিন্ন জায়গা থেকে মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিদের খুঁজে বেড়ান। খুঁজে পেলে তিনি তাদের বাসায় নিয়ে আসেন। ওই ব্যক্তিদের তিনি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেন, খাওয়ান এবং বিভিন্নভাবে তাদের সেবা করেন। এই প্রসঙ্গে সাইফুল্লাহ বলেন, “কিছুদিন আগে একজন মানসিক ভারসাম্যহীনকে নিয়ে এসেছিলাম। ওই ব্যক্তি কথা বলতে পারতো না। কিন্তু এখন সে এখন কথা বলতে পারেন। তার বাড়ি নাটোরে।” ওই ব্যক্তি এখন এখনও সাইফুল্লার বাড়িতে অবস্থান করছেন।
সাইফুল্লা খুব শিগগিরই তার স্বপ্ন পূরণ করতে যাচ্ছেন। তিনি ছোটকাল থেকেই মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষদের জন্য একটি আশ্রম করার স্বপ্ন দেখে আসছেন। তাঁর স্বপ্ন অনুযায়ী আগামী তিন মাসের মধ্যে ২০ জন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষকে নিয়ে একটি আশ্রম তৈরি করবেন বলে জানান। বর্তমানে সাইফুল্লার সাথে সাত জন মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি রয়েছে। তারা হলেন নজরুল, আইজুল, সাইদ, নাসির, নরিম, নুজু, টমাস (বরিশাল)। এদের মধ্যে টমাস নামটি সাইফুল্লাহ নিজেই দিয়েছেন। সাইফুল্লাহ বলেন, “আমি সবার কাছে আর্থিক না হলেও সার্বিক সহযোগিতা চাচ্ছি যাতে করে আমি আমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারি।” মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষদের নিয়ে থাকতে গেলে তার কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আপাতত কোন সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু সাধারণ মানুষ এদের নিয়ে সহ্য করতে পারবে না।” তিনি বলেন, “আমি দৃষ্টান্তমূলক কিছু করতে চাই। যাতে করে আমার উদ্যোগ দেখে দেশের অন্য প্রান্তের মানুষও এভাবে মানবসেবায় এগিয়ে আসেন। এলাকার জনগণ সাইফুল্লাহ’র এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। সাথে সাথে সাইফুল্লাহর সাথে থাকা মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষগুলোকেও তারা ভালোবাসতে শুরু করেছেন।
পরিশেষে বলতে চাই আমাদের পরিবার ও সমাজে অনেক মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ আছে। কিন্ত দেখা যায় ওই সব মানুষ নানাভাবে অত্যাচারিত, নির্যাতিত ও অবহেলার শিকার। আত্মার ও রক্তের সম্পর্কের হলেও কাছের মানুষেরা তাদেরকে ঘৃণা ও অবজ্ঞার চোখে দেখেন। সেক্ষেত্রে সাইফুল্লাহ এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কোন প্রকার আত্মার, রক্তের সম্পর্কের বন্ধন না থাকলেও শুধুমাত্র মানবতার আদর্শ বুকে ধারণ করে তিনি এসব মানুষদের সেবা করে চলেছেন। সুন্দরবন স্টুডেন্টস সলিডারিটি টিমের পক্ষ থেকে সাইফুল্লাহ ইসলামকে স্যালুট জানাচ্ছি।