সাম্প্রতিক পোস্ট

প্রকৃতির সম্পদকে আকড়ে ধরে যার বেঁচে থাকা

নেত্রকোনা থেকে পার্বতী রানী সিংহ
প্রকৃতির সম্পদ মাটি, পানি বাতাসকে নিজের আয়ত্ব করে টিকে থাকার লড়াই করছেন আমাদের শতবাড়ির কৃষক হরিশ চন্দ্রশীল। দিনকে দিন বদলে যাচ্ছে আবহাওয়ার গতিবিধি। আর সেই গতি বিধিতে নিজেকেও মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। টিকে থাকার লড়াইয়ে পুরনো অভিজ্ঞতার সাথে নতুন নতুন কৌশল রপ্ত করেন। তিনি নেত্রকোনা সদর উপজেলার চল্লিশা ইউনিয়নের নূরপুর গ্রামের একজন কৃষক হরিশ চন্দ্র শীল (৪৫)। বংশানুক্রমে ধান বীজ ও বিভিন্ন জাতের সবজি উৎপাদন, বীজ সংরক্ষণ ও বীজ থেকে চারা উৎপাদন ও বিক্রি করে জীবীকা নির্বাহ করে আসছেন। বর্তমানে তার পরিবারের মোট সদস্য সংখ্যা ৭ জন। তাঁর মোট জমির পরিমাণ ৩৫ কাঠা। এর মধ্যে বসতভিটা এক কাঠা, কৃষি জমি ২৮ কাঠা ও পুকুর ৬ কাঠা। পরিবারের ৫ জন সদস্য কৃষির বিভিন্ন কাজে যেমন-ফসল উত্তোলন, সংরক্ষণে তাকে সহযোগিতা করেন।

কৃষি প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণকারী
বর্তমান সময়ে কৃষক হরিশ চন্দ্র শীল নূরপুর গ্রামে কৃষি বিষয়ে অভিজ্ঞ কৃষক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। সংসারের আয়ের একটা বড় অংশ আসে তার বছরব্যাপী শাকসবজি চাষাবাদের পাশাপাশি ধান ও সবজির চারা বিক্রি, হাঁস ও গরু-ছাগল পালন থেকে। তিনি সারাবছর পর্যায়ক্রমে কচু, লতা, বেগুন, মিষ্টিআলু, গোলআলু, বাঙ্গি, মুখী, পালংশাক, সরিষা, টমেটো, শিম, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, লালশাক, ডাটা, কলমিশাক, মরিচ, পুইঁশাক, ঢেড়স, কুমড়া, চিচিঙ্গা, ধুন্দল, করলা, কাকরোল, শসা ও পাটশাক পুকুরপাড়ে ও জমিতে চাষ করেন। অন্যান্য ফসলের মধ্যে আদা, হলুদ,সরিষা, মাছ আলু, পাট, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, গুয়ামুড়ী, লইন, চুকাই,ধনিয়াপাতা চাষ করেন। উৎপাদিত এসব ফসল দিয়ে পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে তিনি বাজারে বিক্রি করেন এবং প্রতিবেশীদেরকেও শাকসবজি ও বীজ দিয়ে থাকেন। তবে পুকুর পাড়ের জমিতে থেকে সারাবছর কলা, লেবু চাষ করেন যা পরিবারের বড় একটি আয়ের উৎস হিসাবে কাজ করে। প্রতিদিনের পরিবারের চাহিদা মেটানোর জন্য এবং প্রতিদিন বাজারে বিক্রির জন্য পেঁপে, লেবু, কলা, ধনিয়া পাতা,পদ্মগুলঞ্চিলতা সংরক্ষণ করেন।

নিজের উৎপাদিত সবজি ছাড়াও তিনি বাড়ির চারপাশে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত খাদ্য উদ্ভিদ যেমন-কচু, লতা,গিমা শাক, বথুয়া শাক, অরহড় কলাই, হেলেঞ্চা, টিপবাহর ইত্যাদি সংগ্রহ করে নিয়মিত খেয়ে থাকেন। নিজস্ব ৬ কাঠা জমির পুকুর পাড়ে পেঁপে, লাউ ও শিম চারা উৎপাদনের পাশাপাশি সবজি চাষ করেন। এই পুকুর থেকে পরিবারের সদস্যদের সারাবছরের আমিষের চাহিদা পূরণ হয়। বর্ষা মৌসুমে কৃষক হরিশ চন্দ্র শীল গ্রামের ছোট ছোট জলাশয় থেকে স্থানীয় জাতের মাছ ধরেও আমিষের একটি বড় অংশের চাহিদা মিটিয়ে থাকেন। বর্ষাকালে জলাশয়ে মাছের প্রাপ্যতা বেশি হলে উদ্বৃত্ত্ব মাছ শুকিয়ে সংরক্ষণ করেন। বর্তমানে তিনি বাড়িতে ৮টি গরু পালন করছেন। গোবর তিনি গর্তে সংরক্ষণ করেন এবং গর্ত কম্পোস্ট সবজির জমিতে জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করেন। ২৮ কাঠা কৃষি জমিতে তিনি দু’টি মৌসুমে ৭ জাতের ধান, যেমন- ব্রি-৪৯, ব্রি-৩২, বিরই, ইয়রচাল ও চিনিশাইল চাষ করেন। বাড়ির চারপাশে তিনি বিভিন্ন ধরণের ফলজ গাছ- আম, জাম, কাঁঠাল, জলপাই, জামবুড়া,আতাফল,লিচু, বেল, আমড়া, কলা, সাজনা, চালতা, লেবু ইত্যাদি রোপণ করেছেন। প্রাটিনের চাহিদা (মাংস) এর ক্ষেত্রে মাসে একদিন বাজার থেকে চাহিদা পূরণ করে। ডিমের ক্ষেত্রে মাসে ৫-৭দিন নিজস্ব উৎপাদন থেকেই বেশি সংগ্রহ করে চাহিদা পূরণ করেন। দুধ প্রতিদিন নিজেদের উৎপাদন থেকে তা পূরণ করেন। আমিষের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজস্ব উৎপাদন থেকে তা পূরণ করার চেষ্টা করেন।নিজেদের টিউবয়েল থেকে পানি পান করেন। ঔষধি গাছ হিসাবে তিনি বাসক, থানকুনি, লজ্জাবতী, ঘৃতকাঞ্চন, মুচিলতা, খাড়াজুরাপাতা ব্যবহার করেন।

নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনকারী ও জৈবকৃষি চর্চাকারী
হরিশ চন্দ্র শীল আদি পেশাকে জীবিকায়নের একমাত্র কৌশল হিসেবে আকড়ে ধরে আছেন। বর্তমানের অস্থিতিশীল অর্থনীতি বা দ্রুত পরির্বতনশীল পরিবেশে স্থায়িত্বশীল জীবনযাপনের পথ তৈরি করে দিয়েছেন। সবজি চাষ ও চারা উৎপাদনে তিনি সব সময় গর্ত কম্পোস্ট সার, নিজের আশপাশে থাকা লতাপাতা ব্যবহার করেন। তিনি আদিকালের কৃষক হিসাবে পরিচিত। তিনি বর্তমান সময়ের বাণিজ্যিক কৃষকের মত অধিক উৎপাদন, অধিক যতেœ, অধিক সার বিষ ব্যবহারে বিশ^াসী নন। তিনি জমিতে বৈচিত্র্যময় সাথী ফসল চাষ, ছাই ব্যবহারের মাধ্যেমে পোকা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন। খুব বেশি প্রয়োজন না পড়লে রাসায়নিক বিষ ব্যবহার করেন না।

বীজ সংরক্ষণকারী
ফসল ও সবজি চাষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বীজ। রোগমুক্ত ভালো ও উন্নত বীজ থেকেই ভালো ফসল সম্ভব। সঠিক সময়ে বীজ রোপণ ফসল চাষের অন্যতম দিক। সারাবছরের চাষের জন্য হরিশ চন্দ্র শীল নিজেই সংরক্ষণ করেন সবজি ও ধান, মসলার বীজ। নেত্রকোনা জেলার অধিকাংশ এলাকাই নিচু হওয়ায় জমিতে পানি জমে যাওয়ায় ওই এলাকার কৃষকদের পক্ষে আমন ধানের বীজতলা ও সবজির বীজতলা তৈরি করা সম্ভব হয়না। কিছু সময়ের জন্য এই এলাকার অনেক জমি পতিত পড়ে থাকে। বর্ষা মৌসুমে জমিতে তেমন কাজ না থাকায় কৃষক হরিশ চন্দ্র পারিবারিক আয়ের উৎস হিসাবে হাওর বা নিচু এলাকার কৃষকদের চাহিদা অনুযায়ী ধানের চারা, যেমন- বিরই, ইয়রচাল, ব্রিধান-৩৪ ইত্যাদি পতিত জমিগুলোতে ধানচারা উৎপাদন করে বিক্রি করেন। ধানের চারা উৎপাদনের পাশাপাশি তিনি নতুন করে বৈচিত্র্যময় সবজি চারা যেমন- টমেটো, মরিচ, বেগুন, লাউ, সীম, মিষ্টিকুমড়া ইত্যাদি উৎপাদন করে গ্রামের কৃষক ও বাজারে বিক্রি করে পারিবারিক আয় বৃদ্ধির পথ উন্মোচন করেছেন। বর্ষাকালীন সময়ে চারা বিক্রি থেকে উপার্জিত অর্থ তিনি ব্যবহার করেন সংকটকালীন সময়ে পরিবারিক চাহিদা মেটাতে এবং শীতকালীন সবজি চাষের জন্য জমি প্রস্ততির কাজে। চারা উৎপাদনের জন্য আলাদাভাবে উচু করে ভিটি জমি তিনি সর্বদা প্রস্তুত করে রাখেন।

লোকায়ত চর্চাকারী
কৃষিকে কেন্দ্র করেই সকাল থেকে সন্ধ্যা অতিবাহিত করেন তিনি। কোন বীজ কেমন করে কখন লাগালে ভালো হবে এসব নিয়ে নিজে নিজেই পরীক্ষা করেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তিনি আশপাশে থাকা উপকরণ ব্যবহার করার চেষ্টা করেন। কলা গাছে গর্ত করে বর্ষা মৌসুমে সবজি চারা করেন, মাটিতে বীজ বপন করলে লতাপাতা, বাকল দিয়ে ঢেকে দেন দ্রুত অঙ্গুরোদগমের জন্য। এছাড়াও তিনি লোকায়ত পদ্ধতিতে মাটির নিচে কচুমুখী ও হলুদ বীজ সংরক্ষণ করেন।

বর্তমান আবহাওয়ার প্রেক্ষিতে রীতিমত যুদ্ধ করেই কৃষিকে আকড়ে ধরে স্থায়িত্বশীল জীবিকায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। কৃষক হরিশ চন্দ্র বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ ও নিরাপদ খাদ্যের যোগানদাতা হিসাবে অন্য কৃষকদের অনুপ্রেরণাকারী।

happy wheels 2

Comments