পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়ি পাখির ডাকে জাগি…
সাতক্ষীরা থেকে সাইদুর রহমান
“বাংলাদেশে ঘুঘুরা মোটেও ভালো নেই, ভালো নেই অন্য পাখিরাও। আমাদের দেশের সর্বত্র একসময় যে প্রাণবৈচিত্র্য ছিল এখন তা প্রায় ধ্বংসপ্রায়। একসময় আমাদের প্রতিটি গ্রামই ছিল পাখিদের অভয়ারণ্য। আর এখন যত্রতত্র পাখি শিকারসহ নানান প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও অপরিকল্পিত নগরায়নের প্রভাব পাখির বৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পাখিদের খাবারের অভাব নেই, বাসা বাঁধার জায়গার অভাব নেই কিন্তু তাদের অভাব শুধু ভালোবাসার। নির্বিচারে শিকারের আওতায় পড়ে ওরা আজ দিশেহারা। “আমরা কি কখনোই সোচ্চার হবো না পাখিগুলোকে বাঁচানোর জন্য? আমাদের শিশুরা কি শুনবে না ঘুঘুর ডাক, দেখবে না ওদের? সুন্দর আর বৈচিত্র্যময় এই পাখি আর ঘুঘুদের বাঁচানোর জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা খুবই জরুরি”। একটি লেখা থেকে কথাগুলো বলছিলেন সাতক্ষীরার আমতলা এলাকার পাখি প্রেমিক মো. আবু কাউছার।
সকল পাখিদের প্রতি আবু কাউসারের রয়েছে অসীম মমতা। তিনি বলেন, “সব গাছে পাখি বসে না। পাখিরা কেবল সে সব গাছে থাকতে পছন্দ করে যেখানে তাদের খাবার রয়েছে। কোকিল শুধু কাকের বাসায় ডিম পাড়ে না, এরা কাকের বাসার মত যে কোন বাসায় ডিম পাড়ে ।”
কাউসার নিজ উদ্যোগে পাখিদের নিয়ে নানামুখি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন দীর্ঘদিন থেকে। কখনো ছুটে যান সাতক্ষীরার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাখির অভয় আশ্রমগুলোতে, দেখেন সেখানকার পাখিদের অবস্থা। স্থানীয় জনগণকে নিষেধ করেন পাখি শিকার করতে। কখনো ছুটে যান স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের বোঝান পাখির গুরুত্ব। তাদের মধ্যে গঠন করে দেন পাখি সংরক্ষণ কমিটি ।
মাছখোলা গ্রামের জুম্মান মেম্বারের বাঁশ বাগান পাখি নোংরা করে এই অজুহাতে যখন বাজি মেরে পাখিদের তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল তখন আবু কাউসার সেখানে ছুটে যান আর জুম্মান মেম্বারকে বোঝান পাখির উপকারিতা। জুম্মান মেম্বার এখন মাছখোলা এলাকার একজন প্রধান পাখি সংরক্ষক। অতিথি পাখিদের নিয়েও চিন্তার শেষ নেই আবু কাউসারের। তিনি কখনো বিলগুলোতে ছুটে যান শিকারিদের পাখি শিকার নিষেধ করতে, কখনো পাবলিক লাইব্রেরিতে পাখিদের নিয়ে পড়াশুনা করতে। আবার কখনো ব্যতিক্রমী এবং আনন্দদায়ক অনেক কিছু করেন তিনি: যেমন তিনি ভবানিপুরের বুদ্ধি-প্রতিবন্ধি নজরুল ইসলামকে শিখিয়েছেন পাখি সংরক্ষণে ছড়া লেখা। নজরুল এখন রাস্তায় রাস্তায় পাখি সংরক্ষণ নিয়ে মানুষকে ছড়া শুনিয়ে বেড়ান।
আবু কাউছার চান সাতক্ষীরাতে পাখি নিধন রোধে মাইকিং ও জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপিও প্রদান করতে। ইতোমধ্যে পাখি নিধন রোধে তিনি ৩০ সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করেছেন। তার এই উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শ্যামনগরের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্য রক্ষা টিমের সদস্য নাহিদ হাসান বলেন, “পাখি ফসলের ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ খেয়ে ফসলকে রক্ষা করে। পাখি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে। পাখি সংরক্ষণে আবু কাউসার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। তিনি সকলের অনুকরণীয় হতে পারেন।”
সমাজে এমন হাজারো আবু কাউসার প্রয়োজন যারা নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর কাজটি করেই যাবেন। তবেই আমাদের সমাজটি সুন্দর হবে আর প্রাণ-প্রকৃতি আর বৈচিত্র্যে ভরে উঠবে। তাই আর একটি পাখিও যেন শিকার করা না হয়। আমরা যেন পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়ি আর পাখির ডাকেই জেগে উঠি!