স্থায়িত্বশীল কৃষি ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে ‘কৃষি বাড়ি’র ভূমিকা
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
স্থায়িত্বশীল কৃষি বলতে শুধু বর্তমান সময়কালের জন্য উৎপাদন নির্ভর কৃষি নয়। এটি বর্তমানের চাহিদা মিটিয়ে টিকে থাকবে অন্তহীন ভবিষ্যৎ পর্যন্ত। পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এর জন্য সরবরাহ করবে তাদের খাদ্য এবং অন্যান্য জীবনধারণ উপকরণ। একইভাবে কৃষি মানে শুধু খাদ্য নয়; জীবনযাপনের মৌলিক চাহিদা পূরণের সকল কাঁচামালের যোগানদার। অন্যদিকে, প্রাণবৈচিত্র্য বলতে প্রাণ আছে এমন সবকিছুর বৈচিত্র্য। আর বৈচিত্র্য মানে অনেক অনেক ভিন্নতা, পার্থক্য, বৈপরীত্য। শুধু সংখ্যায় নয়, গুণেও। স্থায়িত্বশীল কৃষির সাথে প্রাণবৈটিত্র্যের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। কৃষি ক্ষেত্রে যত বেশি প্রাণবৈচিত্র বিদ্যমান থাকবে; সেটি তত বেশি স্থায়িত্বশীল হবে।
এবার আসি কৃষি বাড়ি প্রসঙ্গে। কৃষি বাড়ি বলতে বাড়ির আঙিনা এবং আঙিনা সংলগ্ন বর্ধিত জমিতে বাগানের মাধমে কৃষি কাজ করা। কৃষি বাড়িতে যে কৃষি কাজ করা হবে সেটির প্রধান উদ্দেশ্য থাকবে বাড়ির সদস্যদের চাহিদা মেটানো বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বা টাকা উপার্জনের জন্য নয়। তবে গৃহস্থালীর চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত অংশ প্রতিবেশি, আত্মীয়স্বজন এর মাঝে বণ্টন এবং বিনিময়ে পর বা সরসরি বিক্রি করে অর্থ উপার্জন হতে পারে। কিন্তু, বিক্রি করা কখনোই মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে না। সাধারণত এই কৃষি বাড়ির প্রধান পরিচালক থাকেন বাড়ির প্রধান নারী সদস্য। পুরুষ সদস্য কৃষি বাড়ির বিভিন্ন কাজে সহায়তা করলেও মূল দায়িত্ব পালন করেন না।
যুগে যুগে নারীরা প্রাকৃতিক সম্পদ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের মাধ্যমে টিকিয়ে রেখেছে প্রাণবৈচিত্র্য এবং আমাদের খাদ্য ভান্ডার। সেই সাথে প্রাণবৈচিত্র্যের স্থায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনায় সমৃদ্ধ করেছে নিজেদের জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা। এক সময় উপকূলীয় কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলের প্রতিটি কৃষি বাড়িই ছিল একটি খামার। স্থানীয় পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ (প্রধানত নারীরা) প্রতিটি বাড়িকেই এক একটি কৃষিবাড়ি তৈরি করতেন। এক থেকে দু’টি বসত ঘর, বীজ ঘর, গোয়াল ঘর, হাঁস-মুরগির ঘর, জ্বালানি ঘর, সবজি ক্ষেত, মিষ্টি পানির পুকুর, ধান-ক্ষেত, বসতভিটার চারিধারে ফলজ ও বনজ গাছের বাগান, ঢেঁকি ঘর, গোলাঘর ইত্যাদি ছিল একটি কৃষি পরিবারের কাঠামো, যার মাধ্যমে ঐ পরিবারের টেকসই জীবনযাপন নির্বাহ হতো। কারণ, কৃষিবাড়ির এই কাঠামোর সাথে প্রতিটি উপাদান পরস্পর নির্ভরশীল এবং পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের জীবনের সাথে রয়েছে আন্তঃসম্পর্ক।
কিন্তু, আধুনিক কৃষির উৎপাদন নির্ভর চরিত্র, জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকান্ড এবং বাণিজ্যিক চিংড়ি চাষ বাংলাদেশের উপকূলীয় কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলের অসংখ্য কৃষি পরিবারের এই প্রতিবেশিক বন্ধন বিগত ২-৩ দশক ধরে চরমভাবে ক্ষত-বিক্ষত। কিন্তু আশার কথা হচ্ছে শত প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করে উপকূলীয় কৃষি পরিবারের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন অনেক কৃষি পরিবার।
বারসিক প্রায় ২ দশক ধরে লোকায়ত জ্ঞানের স্বীকৃতি, স্থানীয় কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ভেতর কৃষকের টিকে থাকবার কৌশলকে সাথী করে দেশের ভিন্ন ভিন্ন কৃষিপ্রতিবেশ এলাকায় কাজ করে যাচ্ছে। ২০০১ সাল থেকে বাংলাদেশের অন্যতম কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চল দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকার সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলায় প্রাথমিক সম্পদ ব্যবহারকারীদের সাথে জীবন-জীবিকা ও কৃষি উন্নয়ন, স্থায়িত্বশীল কৃষি চর্চা, লোকায়ত জ্ঞান চর্চা, কৃষি চর্চায় নারীর ভূমিকা ও ক্ষমতায়ন, কৃষিজমি, পতিত জলাশয়, জলধার তথা প্রাকৃতিক সম্পদ নির্ভর জনগোষ্ঠীর সার্বভৌমত্ব রক্ষার লক্ষ্যে কাজ করে আসছে।
তারই ধারাবাহিকতায় শ্যামনগর কর্ম এলাকায় স্থায়িত্বশীল কৃষি ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য ‘কৃষি বাড়ি’ তৈরির কাজ চলমান রেখেছে। এই এলাকার কমবেশি প্রায় বাড়ির আঙিনায় কৃষি কাজ হলেও ’কৃষি বাড়ি’ ধারণা একটু ভিন্ন। মূলত ‘কৃষি বাড়ি’ উপকূলীয় কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলের কৃষিঐতিহ্য, অস্তিত্ব, সংস্কৃতি এবং স্থায়িত্বশীল জীবনযাত্রার দিকনির্দেশনার একটি গুরুত্বপূর্ণ মডেল। যেখানে বিভিন্ন ধরনের প্রাণবৈচিত্র্য থাকবে। বছরব্যাপী ফসল চাষাবাদ হবে। পাশাপাশি, যা অন্যদের জন্য আর্দশ বা শিক্ষণীয় একটি পাঠশালা। এখানে বিভিন্ন ফসলের বীজ সংরক্ষণ, পরামর্শ, প্রশিক্ষণ, বিভিন্ন সম্পদ আদান-প্রদান হবে। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামের কৃষক-কৃষাণীদের মাঝে বিভিন্ন সম্পদ সম্প্রসারণে ভুমিকা রাখবে।
বারসিক এর ১৫ বছরের পথ চলায় লক্ষ্যে শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে প্রাণবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ কৃষি বাড়ি তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। বর্তমানে শ্যামনগর উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে ১০টি ইউনিয়নে (গাবুরা, পদ্মপুকুর, কাশিমাড়ি, রমজাননগর, কৈখালী, মুন্সিগঞ্জ, ভুরুলিয়া, নুরনগর, আটুলিয়া, শ্যামনগর) প্রায় ২৫টির মত ’কৃষি বাড়ি’ তৈরি হয়েছে।
প্রতিটি কৃষিবাড়িই স্থায়িত্বশীল কৃষি চর্চা এবং প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণের এক একটি জীবন্ত উদাহরণ। যেহেতু, কৃষিবাড়ি বীজ সংরক্ষণ থেকে শুরু করে জৈব সার এবং জৈব বালাইনাশক উৎপাদন ব্যবহার এর পাশাপাশি সম্পদ ব্যবস্থাপনার প্রতিটি উপাদান ক্রিয়াশীল থাকে। শুধু কৃষি চর্চা নয়, শুরু হয় জ্ঞান চর্চার এক একটি বিদ্যাপীঠ। চলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জীবন্ত ল্যাবরেটরি। যার ফলে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশে খাপ-খাওয়ানোর সাথে সাথে খুঁজে বের করে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করার নিত্য নতুন উপায়।
সম্পদ ও জ্ঞান ব্যবস্থাপনার সাথে সাথে সম্পদ ও জ্ঞান বণ্টন এবং বিনিময়ের এক একটি সম্পদ কেন্দ্র হয়ে ওঠে প্রতিটি কৃষি বাড়ি। যা সমাজিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে সাথে সাথে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সঞ্চয় ও সম্ভাবনার নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করে সকলের অজান্তেই।
প্রাণবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ আমাদের কৃষিবাড়িগুলো প্রাণ-বৈচিত্র্যে ভরপুর। যা নিজের অজ্ঞাতেই সংরক্ষণ করে চলেছে প্রাণ বৈচিত্র্য ভবিষ্যত পৃথিবীর জন্য। নিচে ২৫টি কৃষিবাড়িতে যে সমস্ত প্রাণবৈচিত্র্য রয়েছে সেগুলো উল্লেখ করা হলো-
এই ২৫টি কৃষি বাড়িতে রয়েছে ২৭৭ ধরনের প্রাণ। আর সংখ্যার বিচারে সেটি কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যাবে। যা সংখ্যায় ও গুণে প্রাণ-বৈচিত্র্যের বিষয়টিকেই প্রতিনিধিত্ব করে। এটি যেমন আমাদের জীবনযাপন নিরাপদ বর্তমান ও সমৃদ্ধশালী ভবিষ্যত। তেমনি এই ২৭৭টি প্রাণ এর জন্য একটি বড় সংরক্ষণ ব্যাংক।
আমাদের স্থায়িত্বশীল কৃষি ও প্রাণ বৈচিত্র্য রক্ষায় ‘কৃষিবাড়ি’ এক একটি উৎকৃষ্ট মডেল। এ বাড়ি দেখে অন্য গ্রামের ও অন্য এলাকার মানুষ উৎসাহিত হবে এবং কৃষিবাড়ি তৈরি করবে। কৃষিবাড়ি তৈরির মাধ্যমে পারস্পারিক সম্পদ ও জ্ঞান বিনিময়ের ভেতর দিয়ে প্রাণ বৈচিত্র্য রক্ষা ও খাদ্য নিরাপত্তা সুরক্ষিত হতে পারে মানুষসহ সকল প্রাণবৈচিত্র্যের।