বাংলার আপেল স্বরূপকাঠির সুফলা পেয়ারা
দেবদাস মজুমদার,বিশেষ প্রতিনিধি,উপকূল অঞ্চল ::
জমির নিবিঢ় ব্যবহার আর পরিকল্পিত চাষাবাদ একটা জনপদকে সমৃদ্ধ করতে পারে। আবার কোন কোন জনপদে একটা বিশেষ ফসলের আবাদ সম্প্রসারণ হয়ে বিপ্লবও ঘটাতে পারে। এমন একটা কৃষি বিপ্লব নিরবে টিকে আছে শত বছর ধরে। সেই বিশেষ কৃষি সেখানকার মাটি ও আবহাওয়া উপযোগি হওয়ায় এবং কৃষকের লোকায়ত জ্ঞানের প্রকৃত ব্যবহার হওয়ায় এগিয়ে চলেছে নিরবে। আর এমন একটি ফসল পেয়ারা যা স্বরুপকাঠী জনপদকে বিশেষ পরিচিতি বা কৃষি সুখ্যাতি এনে দিয়েছে।
দক্ষিণ উপকূলীয় পিরোজপুরের কৃষি সমৃদ্ধ জনপদ স্বরূপকাঠী । খাল নদী বেষ্টিত এ এক প্রাকৃতিক নিসর্গ আর লোকায়ত জ্ঞানের সৃজিত কৃষি নির্ভর জনপদ। সেখানে বিশেষ একটা কৃষি বাংলার আপেল খ্যাত পেয়ারা স্বরূপকাঠীকে একদিকে কৃষকের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি যেমন এনে দিয়েছে তেমনি পেয়ারা আবাদে এনে দিয়েছে বিশেষ পরিচিতি। তাই স্বরূপকাঠীর নিভৃত আটঘর কুড়িয়ানার পেয়ারার পরিচিতি দেশ ছাড়িয়ে এখন বিদেশে। বৃহত্তর বরিশাল বিভাগের পিরোজপুরের স্বরূপকাঠীর “বাংলার আপেল” খ্যাত পেয়ারার কদর এখন বৃহত্তম এশিয়া মহাদেশের মধ্যে প্রথম। কয়েক হাজার পেয়ারা চাষি পরিবার ও ব্যবসায়ীরা এ পেশায় বংশ পরম্পরায় জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। সুফলা পেয়ারা এখন আর কুড়িয়ানার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ঢাকাসহ সারাদেশ জুড়ে এখানকার সুস্বাদু পেয়ারা সরবরাহ হয়। এখন চলছে পেয়ারার ভরা মৌসুম। পেয়ারা চাষিরা জানিয়েছে এ বছর আশানুরুপ ফলন হলেও সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা ও পর্যাপ্ত পাইকারের অভাবে এলাকার চাষিরা ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না।
কৃষকরা বলছেন, এ অঞ্চলের অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণেই রয়েছে পাইকারের অভাব। অন্যদিকে নেই পেয়ারা সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থা। সরকারী কিংবা বেসরকারী কোন হিমাগার না থাকায় পেয়ারা ফলনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এর ফলে শত বছরের পুরনো এই কৃষি পণ্য উৎপাদন করে চরম হতাশার মধ্যে রয়েছে এখানকার চাষীরা। পেয়ারা চাষীরা মনে করেন হিমাগারের মাধ্যমে যথাযথ সংরক্ষণ, রোগ প্রতিরোধ ও যাতায়াতের আধুনিকীকরণ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে দক্ষিণাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী ফল পেয়ারা থেকে এলাকার অর্থনৈতিক উন্নতি পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয় আরও বাড়িয়ে দেবে।
স্বরূপকাঠির আটঘর কুড়িয়ানার পেয়ারার চাষ এখন পার্শ^বর্তী ঝালকাঠি সদর, বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলাসহ দক্ষিণের এই তিন জেলার অন্তত ৫০ গ্রামে বিস্তৃত। বিশাল এলাকা নিয়ে নজরকাড়া পেয়ারা বাগান। তাই এ জনপদের যত দূর চোখ যায় শুধু পেয়ারার পরিকল্পিত বাগান। তবে বিশেষ করে আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়ন, সমুদয়কাঠি ও জলাবাড়ীসহ তিন ইউনিয়নে ১ হাজার ৩৪৫ টি পরিবার পেয়ারা চাষ দ্বারা যুগ যুগ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। এ উপজেলার কাঠ ব্যবসার পরেই মৌসুম ভিত্তিক এই পেয়ারা চাষ অর্থনীতির একমাত্র উৎস বলেই স্বীকৃত। প্রতি বছর এ মৌসুমে ইউনিয়নের বিভিন্ন শাখা খাল ও খাল তীরবর্তী স্থান জুড়ে ব্যবসায়ী, আড়ৎদার, পাইকারদের ট্রলার ও চাষীদের পদচারনায় যেন উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। পেয়ারার মৌ মৌ গন্ধে তখন আমোদিত হয়ে ওঠে গোটা উপজেলার প্রত্যন্ত জনপদ।
স্বরূপকাঠীর সংগীতকাঠি, খায়েরকাঠি, ভদ্রানন্দ, বাস্তুকাঠি, ভাঙ্গুরা, আদাবাড়ী, বাক্ষ্রণনকাঠি, ধলাহার, জিন্দাকাঠি, আটঘর, কুড়িয়ানা, ইদলকাঠি, মাদ্রা, বেঙ্গুলি, আদমকাঠি, অশ্বত্থকাঠি, সেহাংগল ও আন্দারকুলসহ ২৬ গ্রাম নিয়ে রয়েছে বিস্তৃত এ পেয়ারার আবাদ। যা প্রতি বছর ১০ থেকে ১২ হাজার মেট্রিক টন বিক্রিত পেয়ারা থেকে ৮-৯ কোটি টাকা উপার্জিত হচ্ছে। এ তথ্য জানিয়েছেন, স্থানীয় পেয়ারা চাষীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
বাংলা আষাঢ় থেকে শুরু করে একটানা ভাদ্র ও আশি^ন মাস পর্যন্ত চলে পেয়ারা মৌসুম। মৌসুমের প্রারম্ভে পেয়ারার দাম ভাল থাকলেও শ্রাবণের শেষ সময়ে তা নেমে যায় কয়েকগুন নিচে। যে পেয়ারা প্রতি মণ আষাঢ়ে বিক্রি হয় ৫৬০-৭০০ টাকা। শ্রাবণে কখনো তা দাড়ায় ৩০-৪০ টাকা মনে। ফলন প্রাচুর্যে বিশেষ করে ওই সময়ে কৃষাণ মজুরির ভয়ে চাষীরা গাছ থেকে পেয়ারা না পাড়ায় বাগানে বসেই ৩৫-৪০ ভাগ পেয়ারা নষ্ট হয়ে যায়। যা গো খাদ্যে পরিণত হয়। স্বাদে গন্ধে অতুলনীয় এ অর্থকারী ফলটি সংরক্ষণে আজও এ অঞ্চলে গড়ে উঠছে না কোন হিমাগার। হিমাগারের অভাবে ফলন প্রাচুর্যে ব্যবসায়ীদের নিকট ওই সময়ে কম দামে পেয়ারা বিক্রি করায় প্রতি বছর দেনায় জর্জারিত হচ্ছে অধিকাংশ পেয়ারা চাষীরা। যে কারনে লোকসান ভয়ে ক্রমেই এ পেশা থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে চাষীরা। ধীরে ধীরে সংঙ্কুচিত হয়ে আসছে এ পেশা।
স্বরূপকাঠী উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানাগেছে, নেছারাবাদের ৬৪৫ হেক্টর জমির পেয়ারা বাগানের মধ্যে আটঘর কুড়িয়ানাতেই ৫২২ হেক্টর জমির পেয়ারা বাগান রয়েছে। যা প্রতি হেক্টর জমিতে ৮-৯ টন পেয়ারা ফলে। উপজেলায় ২ হাজার ২৫ টি পেয়ারা বাগান রয়েছে। এ বছর চাষীদের আশান্নিত ফলনেও পেয়ারায় এনথ্রাকনোস নামক এক প্রকার ভাইরাস যা, স্থানীয় ভাষায় (পেয়ারার সিট) পড়া রোগ বলে সনাক্ত করা হয়েছে। এতে করে এমনিতেই বাগানে ঝরে পড়ছে অধিকাংশ পেয়ারা। পেয়ারা সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরনসহ সরকারী বেসরকারী পৃষ্টপোষকতার অভাবে প্রতি বছর মৌসুম শেষে হিসাব নিকাশে লোকসান গুনতে হচ্ছে চাষীদের।
স্থানীয়জনেরা জানান, আনুমানিক দুইশত বছর আগে আটঘরের কালিচরন মজুমদার নামে এক ব্যক্তি ভারতের গয়া (পেয়ারা) থেকে এই জাতের পেয়ারার বীজ বপন করেন। সেই থেকেই ছড়িয়ে পড়েছে স্বরূপকাঠির পেয়ারা চাষ। তবে স্থানীয় বেশ ক’জন প্রবীন পেয়ারা চাষী জানান, আনুমানিক ১৯৪০ সাল থেকে নেছারাবাদে শুরু হয়েছে পেয়ারার বানিজ্যিক আবাদ। সেই থেকে এই পেয়ারার বানিজ্যিক প্রসারতা বৃদ্ধি পেলেও সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে এখানকার চাষীরা পাচ্ছেনা কোন আধুনিকায়ন সুযোগ-সুবিধা।
আটঘর কুড়িয়ানা গ্রামের পেয়ারা চাষী মো.মোস্তফা কামাল জানান, তার কয়েকটি বড় বড় পেয়ারার বাগান রয়েছে। আষাঢ়ের প্রথমে সে প্রতি মন পেয়ারা বিক্রি করেছে ৫৬০-৭০০ টাকা পর্যন্ত। এই শ্রাবণে ফলন প্রাচুর্যে গত ২৪ জুলাই শুক্রবার আটঘরের পেয়ারা হাটে ২০মন পেয়ারা এনে ২৫০ টাকা ধরে বিক্রি করতে হয়েছে। তিনি আরো জানান, এখনো পেয়ারার যে দাম আছে তা চাষীদের সহনীয় পর্যায়ে আছে। কিন্তু শ্রাবণের শেষ সময়ে থেকে এই পেয়ারা মন প্রতি দাম দাড়ায় ৩০-৪০ টাকা ধরে। ৩ জন পাড়াইয়াকে রোজ দিতে হয় ১ হাজার ৫০০ টাকা করে। সব মিলিয়ে ওই সময়ে প্রতিদিনই লোকসানের শিকার হতে হয়।
শত বছরের ঐতিহ্যবাহী পেয়ারা শিল্পকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে সরকারের কৃষি বিভাগসহ সংশি¬ষ্ট সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে বলে স্থানীয় জন প্রতিনিধি, কৃষক সহ এলাকাবাসী অভিমত ব্যাক্ত করেছে। এ ব্যপারে উপজেলার কুড়িয়ানার ইউপি চেয়ারম্যান শেখর কুমার সিকদার বলেন, এলাকার অর্ধশত গ্রামের চাষীরা যুগ যুগ ধরে এ পেয়ারা চাষ করে আসছে। কিন্তু দীর্ঘদিনেও উদ্যোক্তার অভাবে হিমাগারসহ প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প নির্মিত না হওয়ায় ও পাশাপাশি লাভের চেয়ে উৎপাদন খরচ দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় চাষীরা পেয়ারা চাষাবাদে আগ্রহ হারাচ্ছে। এখানে হিমাগার ও একটি পেয়ারার জেলি তৈরীর কারখানা স্থাপন জরুরী।
স্বরূপকাঠী বিসিক কর্মকর্তা গোবিন্দ চন্দ্র সরকার ও চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রি সহ-সভাপতি আতাউর রহমান আলম জানান, উদ্যোক্তা ও পরিকল্পিত ভাবে তা বাস্তবায়নে সম্ভব হলে একটি হিমাগার ও জ্যাম-জেলী প্রস্তুত কারখানা স্থাপন করা সম্ভব। তা করতে পারলে এখানকার ঐতিহ্যের পেয়ারা আরও সমৃদ্ধভাবে বেঁচে থাকবে।
স্বরূপকাঠী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. রিফাত সিকদার জানান, সরকার নেছারবাদে দুইটি কৃষি পণ্য বিপনন কেন্দ্র তৈরীর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী বছরই এর কাজ শুরু হবে বলে তিনি আশা করছেন। এর ফলে কৃষকেরা একদিকে তাদের অতিরিক্ত ফসল সংগ্রহ করতে পারবে অন্যদিকে পেয়ারার মৌসুম ছাড়াও অধিকমূল্যে পেয়ারা বিক্রি করতে পারবে।