একদিন স্বপ্নের দিন
বরেন্দ্র অঞ্চল প্রতিনিধি
“আখির দু’চোখে যেন আজ স্বপ্নের আকাশ দেখতে পাই। ওর বয়স আট। রাজশাহী বিশ্ব বিদ্যালয়ের পাশের বুধপাড়ার রেললাইনের ধারে ছোট্ট ঘরে দাদির সঙ্গে থাকে। মা লিভার ক্যান্সারে মারা গেছেন। বাবা মাদকাসক্ত হয়ে ট্রেনের নীচে কাটা পড়ে চিকিৎসার অভাবে মারা যান। গ্রামে গ্রামে ভিক্ষা করে দাদি যা পান, তাই দিয়েই দাদি-নাতনির দিন চলে। বাড়ি সামলাতে হয় বলে স্কুলে যাওয়া হয় না।” নবজাগরণ ফাইন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবক রহমান সোহাগ বলছিলেন উক্ত কথাগুলো। তিনি আরও বলেন, “এমন সব আশাহত শিশুদের স্বপ্নের আলোয় পৌছে দিচ্ছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীগণ। লেখাপড়ার পাশাপাশি তারা নিজেরা গড়ে তুলেছেন স্বেচ্ছাসেবী একটি সংগঠন। যার নাম নবজাগরণ ফাউন্ডেশন। ২০১২ সালে কিছু স্বপ্নবাজ তরুণদের হাত ধরে যাত্রা হয় নবজাগরণ ফাউন্ডেশন। যার সকল সেচ্ছাসেবক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। রাজশাহী নগরের বিভিন্ন বস্তি এবং অবহেলিত শিশুদের লেখাপড়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে ২০১৪ সালে নবজাগরণ বিদ্যানিকেতন নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজেদের লেখাপড়ার ফাঁকে অবসর সময়ে পথ শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান করেন। সেই সঙ্গে শিশুদের পরিবারে গিয়ে তাদের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা হয়। শিশুর অধিকার এবং শিশুর স্বপ্ন জাগানিয়ায় সংগঠনটি দীর্ঘদিন থেকে কাজ করে আসছে।
বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই শিশু। এই শিশুরাই বিশ্বের ভবিষ্যতের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী শিশুরা ভালো অবস্থায় নেই। বর্তমানে সারা বিশ্বে যুদ্ধ, দারিদ্র্য, পুষ্টিহীনতা ও প্রাণঘাতী রোগ শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত করছে। বাংলাদেশের শিশুরাও ভালো অবস্থায় নেই। প্রায় ৫০ লাখ শিশু শ্রমিক রয়েছে বাংলাদেশে, যারা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসাসহ সব ধরনের মৌলিক প্রয়োজন থেকে বঞ্চিত। অভাবের তাড়নায় তারা রাস্তায় পাথর ভাঙে, গার্মেন্টে কাজ করে, ঠেলা গাড়ি চালায়, কাগজ কুড়ায়, পার্কে ফুলের মালা বিক্রি করে এমনকি এ বয়সেই চুরি করছে ও পকেট মারার মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। সম্প্রতি বাংলাদেশে শিশু হত্যা বৃদ্ধির পেছনে এটিও একটি কারণ। এরা কোনোমতে খেয়ে পরে বাঁচতে পারলেই খুশি হয়। এসব শিশু ভালোভাবে বেড়ে ওঠার কোনো স্বপ্ন দেখে না বা দেখতে জানেনা। দেখতে জানলেও তাদের সুযোগ দেওয়া হয়না। সারাবিশ্বে যখন বিশ্ব শিশু দিবস পালিত হয় তখন বাংলাদেশের শিশুরা এক বেলা খাওয়ার অর্থ জোগাতে ছোটে, তারা জানতেও পারেনা বিশ্ব শিশু দিবস কি এবং কেন!
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। একটি জাতির ভবিষ্যত নির্ভর করে তার শিশুদের সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠার ওপর। শিশুরাই পারে স্বপ্নের সোনালি রঙে ভবিষ্যতকে রাঙিয়ে তাকে বাস্তবে রূপ দিতে। কিন্তু এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, আজ আমরা কান পাতলেই শুনতে পাই অবহেলিত শিশুদের বিরামহীন ক্রন্দন। বিশ্বব্যাপী শিশু দিবস পালন করা হলেও শিশুদের যথাযথ অধিকার এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। খবরের কাগজে চোখ বুলাতেই দেখতে পাই শিশু নির্যাতনের বিষাদময় চিত্র, যা আমাদের সচেতন বিবেককে মর্মাহত করে, মনুষ্যত্বকে ধিক্কার দেয়। এই অবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন।
শিশু অধিকার, শিশুদের নিরাপত্তা, তাদের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি ইত্যাদি বিষয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য জাতিসংঘ ২০ নভেম্বর তারিখ টিকে ‘সর্বজনীন শিশু দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় নবজাগরণ ফাউন্ডেশনও সম্প্রতি এই দিবসটি পালন করে সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে। অনুষ্ঠানে নবজাগরণ ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক আরিফুলই ইসলাম বলেন, “সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা আমাদের অনেক দিনের। নবজাগরণ বিদ্যানিকেতন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা সেই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বিভিন্ন উৎসবে আমরা সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের মধ্যে পোশাক বিতরণ করে থাকি। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা বিশ্ব শিশু দিবস পালন করলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায়.১৬০ জন স্বেচ্ছাসেবী একজন করে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে সারাদিন ঘোরে। দেশের হতে যাওয়া কর্ণধারদের সঙ্গে দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধারদের মেলবন্ধন সৃষ্টিও আমাদের একটি উদ্দেশ্য।”
‘সর্বজনীন শিশু দিবসটির উপলক্ষে আয়োজিত হয় “একদিন স্বপ্নের দিন”। এদিন প্রতি দুইজন স্বেছাসেবক এর দায়িত্বে একজন করে সুবিধাবঞ্চিত শিশুকে দেওয়া হয় তার দিনটাকে স্বপ্নের মতো করে উপহার দেওয়ার জন্য। এরপর সদলবলে যাওয়া হয় চিড়িয়াখানায়। বিভিন্ন মজার মজার খেলার মাধ্যমে তাদেরকে আনন্দ দেওয়া হয়। শিশুদের বিভিন্ন রাইড এ চড়ানো হয়।
দুপুরে খাবারের বিরতির পর আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র উপদেষ্টা ও সমাজকর্ম বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক সাদেকুল আরেফিন মাতিন বলেন, “শিশুদের মৌলিক অধিকার যথাযথভাবে পূরণের মাধ্যমেই গড়ে উঠবে সোনার বাংলা। আর তারই অংশ হিসেবে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জীবনমান উন্নত করার লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে নবজাগরণ ফাউন্ডেশন। ”
বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিসংখ্যান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. মনিমুল হক ও বারসিক এর আঞ্চলিক সমন্বয়কারী শহিদুল ইসলাম। আরো উপস্থিত ছিলেন নবজাগরণ ফাউন্ডেশন এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আহমেদ সজীব, সাবেক সভাপতি আবুহুরায়রা, সাবেক সভাপতি হাসিব আল মামুন,আশিকুর রহমান শাহ্, মো. সামিউল ইসলাম, রাজিয়া সুলতানা,নাফিসা তাসনিম ঝিলিক প্রমুখ।
সভাপতির বক্তব্যে আদিত্য হাসান শরীফ বলেন, “সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে আমাদের সামাজিক ধারার সাথে মিশিয়ে রাখার লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছেন নবজাগরণ ফাউন্ডেশন। আর তারই মাইলফলক হিসেবে আজকের এই “একদিন স্বপ্নের দিন”। আমাদের প্রত্যাশা আজকের দিনটির মতো করে অতিবাহিত হোক তাদের জীবনের দিনগুলো। আমরা তাদের নৈতিকতা, মানবিক বোধ সম্পর্কে শিক্ষাদান করার মাধ্যমে জীবনমান উন্নয়নে দিক নির্দেশনা প্রদান করার চেষ্টা করে চলেছি।” মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, “সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের মুখে এই সুন্দর হাসিটাই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্য। “