মেঘলাল দাসের জীবনের কথকতা
মানিকগঞ্জ থেকে ফিরে ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল:
মেঘলাল দাস (৭১), মানিকগঞ্জের সদর উপজেলা বড়বড়িয়াল, ঋষিপাড়া গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতা বৈকুণ্ঠ দাস আর মা কালিতারা দাসের একমাত্র সন্তান তিনি। শিক্ষাগত যোগ্যতায় তিনি অক্ষরজ্ঞানহীন। পারিবারিক পেশা বাঁশবেতের কাজ; যাকে স্থানীয়ভাবে শিল্পকাজ বলা হয়ে থাকে।
পরিবারে তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে। পারিবারিক সম্পদ বলতে শুধু বাড়ি ভিটাটুকুই সম্বল। পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসাথেই বসবাস করেন। ছেলে দীর্ঘদিন মালয়েশিয়া ছিল। সেখানে কাজ ও ভিসা জটিলতার কারণে প্রায় ৮ মাস জেল খেটে অসুস্থ অবস্থায় দেশে ফিরেছেন। বর্তমানে সে পাড়ায় একটা ছোট দোকান চালায় আর শিল্পকাজ করে পুরো সংসারের ভরণপোষণ করে। ছেলের ঘরে দুই মেয়ে আর এক ছেলে। পরিবারের সকলেই মিলে একসাথে বসবাস করেন। এই ঋষিপাড়ায় কোন সরকারি স্কুল নেই। যার দরুণ এখানে অনেক ছেলেমেয়ে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও স্কুলে যেতে পারে না।
মেঘলাল দাসের জন্ম ও বেড়ে ওঠা মানিকগঞ্জের বড়বড়িয়াল গ্রামের ঋষিপাড়ায়। ঋষিপাড়ায় মোট ৮০-৮৫ ঘর মানুষ বসবাস করেন। অধিকাংশ সংখ্যালঘু মানুষ হওয়ার কারণে এই গ্রামে উন্নয়নের ছোয়া নেহাতই কম। মাতৃগর্ভে থাকার সময়ই তার বাবা মৃত্যুবরণ করেন। তার মা মানুষের বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে তাকে খাওয়াতেন বলে তিনি মানুষের মুখে শুনেছেন। তিনি বলেন, “ছোটবেলায় মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কাম করতাম-মানুষ খাইতে দিত। নানার বাড়িতে ঘুরতে যাইতাম। অনেক ভালা সময়ই আছিল। গাঙ্গ দিয়া পানি আসছে, সেই পানি খাওন যাইতোনা-নুনা পানি। নদীতে স্টিমার যাইতো আর ইলিশ মাছ পাওয়া যাইতো। আমি নিজেও ইলিশ মাছ ধরছি।”
নিজের বন্ধুবান্ধবরা বেশির ভাগ মইরা গেছে। অনেকে ভারত চলে গেছে। বন্ধুদের সাথে কত খেলাধুলা করতাম। তারা এখন কেউই নাই। নিজের বাবা-মা সম্পর্কে তিনি বলেন, “মা মারা যায় ১৯৭১ সালে। তারপর অনেক কষ্ট করতে হইছে। বাবারেতো চোখেই দেখি নাই।”
তিনি বলেন, “২০০৭ সালে হঠাৎ হার্ট এটাক হয়। তখন থেকে বুকে ব্যথা। ব্যথায় কোন কাজ করতে পারতাম না। ব্যথা উঠলে সারাবাড়ি গড়াগড়ি খাইতাম। অনেক ডাক্তার কবিরাজ দেখাইছি। ২০১৪ সালে ব্রেন স্ট্রোক হয়। তারপর থেকেই দুই পা আর বাম হাত কাজ করেনা। হাঁটতে-চলতে পারিনা, কোন কাজও করতে পারিনা। হুইল চেয়ারে চলাচল করতে হয়। তাও আবার বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারি না।” মেঘলাল দাসকে প্রাকৃতিক কাজের জন্যও অন্যের উপর নির্ভর করতে হয়। বাড়িতে কেউ না থাকলে বিরাট সমস্যা হয়। ডান হাতটা দিয়ে কোন রকম খেতে পারেন তিনি। এই শারীরিক সমস্যায় কেউ সাহায্য করে আবার কেউ বিরক্তও হয়। কেউ আবার দূরে দূরে থাকে। মেঘলাল দুঃখ করে বলেন, “আমি কিছু করতে পারি না বলে খুব দুঃখ হয়। এখন কিছু বলতেও পারিনা। ভগবানের কাছে বলি মানুষরে অন্য অসুখ দিয়ো কিন্তু এমন অসুখ দিয়ো না। আমি এখন কোথাও যাইতে পারিনা। পায়খানা-প্রস্রাবও অন্যের সাহায্য ছাড়া করতে পারি না। আমার দুঃখ বলে বুঝান যাইবোনা।”
তিনি বয়স্ক ভাতা পান। তিন মাস পরপর ১৫০০ টাকা। প্রতিবন্ধী হিসেবে কোন ভাতা পান না। গ্রামের মেম্বার এটা করে দিয়েছে। তিনি ভাতা সম্পর্কে বলেন, “এই ভাতা যথেষ্ট না। মাসে আমার ঔষুধ লাগে ২০০০ টাকার। এটা দিয়ে খাওন পরন হয় কি কইরা। এটা দিয়ে জীবন চালানো সম্ভব না। তাই পেটের চিন্তার সাথে এহন অসুখের চিন্তাও করণ লাগে। তারপরও এই টেকা কিছুটা হইলেই কামে লাগে।” তিনি বলেন, “সবাই সাহায্য উঠাইয়া ৮০০০ টাকা দিয়ে একটা হুইল চেয়ার কিনা দিছে। কিন্তু তার অবস্থাও ভালো না। একছেলের আয়ের উপর ৭ জন খাওয়ার মানুষ।”
মেঘলাল দাস স্বপ্ন দেখেন, যদি তিনি তার চিকিৎসা করাতে পারতেন তবে নিজে কাজ করে খেতেন। কারণ এমন করে বসে বসে থাকতে তার ভালো লাগেনা। আর তাদের মতো মানুষের জন্য যদি গ্রামেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যেতো তবে সবচেয়ে ভাল হতো। প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক মানুষদের জন্যও স্বাস্থ্য কেন্দ্র দরকার। গ্রামে ভালো মানুষ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যায়, তাই তাদের জন্য চিকিৎসা দরকার।
মেঘলালকে নিয়ে মানুষ ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে যায় অনেক সময়। কারণ সে সবসময়ই মানুষের উপর নির্ভরশীল। তার স্ত্রী নিজেও অসুস্থ। সম্প্রতি পিছলে পড়ে তারও হাত ভেঙ্গে গেছে। এর মাঝেও সেই তার সব সেবাযত্ন করেন। এভাবে প্রতিদিন এক কষ্টের, বেদনার জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হচ্ছে মেঘলাল দাসের। সে এই জীবন থেকে মুক্তি চায়, চায় ভালোভাবে বাঁচতে।