ঘরের পাশে চেনা মানুষ
ঢাকা থেকে ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল
একদম ভোরবেলা থেকেই টয়লেটের দরজায় লাইন দিতে হয়, এরপর পানির জন্য দীর্ঘ এক লাইন। পানি এনে প্রতিদিন রান্নার কাজ করতে হয়। যেদিন পানির সমস্যা হয় সেদিন তাদের রান্না হয় না, খাওয়াও হয় না আর অন্য কাজতো বাদ দিলাম।
তাদের প্রতিটি দিনই অনেক চ্যালেঞ্জিং-অনেক কষ্টের আর অনেক হিসেবের। সময় তাদের উপর সবসময়ই প্রতিশোধ নেয়। রান্নার সময় না থাকলেও গৃহকর্মীর কাজ থেকেও তাদের মুক্তি নেই। সকাল বিকাল ও রাতে তাদের দৌড়াতে হয় পেশার জন্য। পুরুষরা দৌড়ায় রিকসা, গ্যারেজ, দোকান ও অন্যান্য কাজে।
সবচেয়ে ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে বস্তির শিশু ও কিশোররা। মা-বাবা চলে যায় কাজে আর তারা থাকে প্রতিবেশির জিম্মায় অথবা পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের কাছে। তাই তাদের খাদ্য, স্বাস্থ্যগত একটি বড় ঝুঁকি লক্ষ্যণীয়। বস্তির অধিকাংশ শিশুরাই সারাবছর ধরেই অসুস্থ থাকে।
ঘরের সামনেই পড়ে আছে প্লাস্টিক, খাবারের উচ্ছিষ্ট, মরা ইদুর, মল মূত্রসহ হাজারো আবর্জনা। মাছি ভনভন করছে আর এরই মধ্যে একটি শিশু হাতে খাবার নিয়ে ময়লার উপর দিয়ে হাটছে। এগুলো খুব সাধারণ চিত্র বস্তিবাসীদের জীবনে। সেদিন দেখলাম একটি টয়লেটের ট্রেংকি উপচে পড়ে সারা বস্তি ময়লা ও গন্ধে সয়লাব। কেউ দেখার নেই।
বয়স্করাও বস্তিতে নানান কাজের সাথে যুক্ত থাকেন। রান্না বান্না, শিশুদের দেখভাল করা, ঘরবাড়ি গোছানোর কাজও তারা করে। কিন্তু বয়স্কদের একটি বড় অংশই নানান শারীরিক সমস্যায় জর্জরিত। শ^াসকষ্ট, এজমা, চর্মরোগ, জ¦রজারীসহ নানান কিছুতেই তারা সারাবছর আক্রান্ত হন। তাদের ভাতা পাওয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশই ভাতা থেকে বঞ্চিত।
মেয়েটির সাথে আমাদের দু থেকে তিন দিন দেখা হয়েছিল। হঠাৎ করেই তাকে আর দেখা যাচ্ছিল না। আর কিছুদিন পর জানতে পারলাম তাকে তার মামা বাড়ি পাঠিয়ে বিয়ে দেয়া হয়েছে। তার বয়স হবে ১৪/১৫ বছর। তার মাকে জিজ্ঞেস করলাম কেন এটা করলেন? তার উত্তর ছিল বস্তির পরিবেশ খারাপ তাই বিয়ে দিয়ে দিলাম। এটা ছাড়া আর কোন উপায় নাই গরিব মানুষের। তাই বাল্য বিবাহ বস্তিবাসীদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ!
কিশোর ও যুবকরা নিয়মিত নানা ধরণের মাদকাশক্তিতে যুক্ত হচ্ছে। এক্ষেত্রে বস্তির মানুষদের বক্তব্য হলো বস্তির থেকে বাইরের মানুষরাই বেশি মাদকাশক্ত কিন্তু তারা বস্তিতে এসে মাদক গ্রহণ করে। কেউ কিছু বলার নেই। মাঝে মাঝে পুলিশ এসে বস্তির ছেলেদের ধরে নিয়ে গেলেও প্রকৃত আসক্ত ও ব্যবসায়ীরা ধরা পড়ে না।
সেদিন দেখলাম বস্তির একটি অংশ ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। কারণ জানতে চাইলে তারা বললো, মালিকানাধীন বস্তি মালিক বলেছে তাই তাদের ঘরবাড়ি ভেঙ্গে চলে যেতে হচ্ছে। আর এটার জন্য তাদের পর্যাপ্ত সময়ও দেয়া হয়নি। আশপাশের সকলেই আতঙ্কিত কখন যে তাদেরও চলে যেতে হয় সেটা ভেবে।
আমরা এতক্ষণ যে বস্তির কথা বললাম এর নাম সোনামিয়ার টেক। এই মানুষগুলো আমাদের খুব চেনা। আমাদের থাকার জায়গার খুব কাছেই হয়তো তারা থাকে। প্রতিদিনই আমরা তাদের দেশি রাস্তায়, পথে,গাড়ীতে, বাড়িতে কাজে। এই বস্তির অধিকাংশ মানুষই ভোলার। নদী ভাঙ্গন ও প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে তারা এই শহরে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। প্রায় এক হাজার পরিবার এই বস্তিকে কেন্দ্র করে বসবাস করে। তাদের দুঃখকষ্টের কোন শেষ নেই। মানবেতর একটা জীবন তারা বইয়ে বেড়ায়। শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্য, বাসস্থান কোন কিছুরই কোন নিশ্চয়তা নেই তাদের। তবু তারা এই কষ্টের জীবনকেই সঙ্গী করে সংগ্রাম করে চলেছেন। প্রতিদিন যেমন তাদের নানান রকম সংকটে পড়তে হয়, ঠিক প্রতিদিনই তারা নিজেদের প্রস্তুত করে পরের সংগ্রামের জন্য।
বস্তিতে একদিকে যেমন দুঃখ কষ্ট, ঝগড়া মারামারি লেগেই থাকে আবার তাদের একসাথে ভাগ করে নেয়ার প্রবণতাও লক্ষ্যণীয়। তারা হাসে গল্প করে একজন আরেকজনকে দেখে। কেউ অসুস্থ হলে নিজেরা টাকা তুলে তাদের চিকিৎসাও করায়। নিজে টিকে থাকার জন্য অনেকেই এখানে মুরগি পোষে, কেউবা কবুতর, টার্কি, ছাগল আবার কেউ সবজিও করছে। এই টিকে থাকাটাকে আরও শক্তিশালী করার জন্য বারসিক কাজ করে যাচ্ছে। বারসিক বস্তি ও নি¤œ আয়ের এই মানুষদের সাথে অভিজ্ঞতা বিনিময় করছে, সরকারের নানান সুযোগ ও অধিকার সম্পর্কে জানাচ্ছে প্রতিটি ঘরে ঘরে বিভিন্ন বয়সী মানুষদের। তাদের একটাই প্রশ্ন সব সময় শুনতে হয়, এত কিছু সরকার করে কিন্তু আমরা পাই না কেন? আমরা তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে পরামর্শ দেই। দেই ঘুড়ে দাঁড়ানোর সাহস।
নিশ্চয়ই সরকার ও তার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো এই বস্তিবাসীদের পাশে দাঁড়াবে। হাত বাড়িয়ে দিবে বন্ধুত্বের-ভালোবাসার। সকল মানুষগুলোই পাবে একটি নূনতম মানবিক জীবন ও বেঁচে থাকার অধিকার।