রাজেন্দ্রপুর কৃষক সংগঠনের স্বপ্ন জয়ের গল্প
নেত্রকোনা থেকে পাবর্তী সিংহ
বৈশ্বিক মহামারী করোনা আজ সারা দুনিয়ার মানুষের কাছেই এক আতঙ্কের নাম। বাংলাদেশও এই মহামারী থেকে মুক্ত নয়। বিগত প্রায় আড়াই মাস ধরে সাধারণ ছুটির নামে এই মহামারীর কারণে দেশের সকল মানুষ প্রায় অবরুদ্ধ। সেই সাথে বৈশাখ জৈষ্ঠ্য মাসে অস¦াভাবিক বৃষ্টিপাত, ঘুর্ণিঝড় আম্ফান, টর্নেডো, কালবৈশাখী ঝড়, পাহাড়ি ঢল, বজ্রপাতসহ নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশের শরীরের আজ নানামাত্রায় ক্ষতবিক্ষত। এত নেতিবাচক খবরের মাঝে যখন দেশের অধিকাংশ মানুষ প্রায় দিশেহারা তখন রাজেন্দ্রপুর কৃষক সংগঠনের সদস্যদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাস্তবরূপ দিয়েছে তাদের স্বপ্নের। এই এবছর বোরো মৌসুমে সংগঠনের সদস্যরা সম্মিলিতভাবে সাড়ে উনত্রিশ লক্ষ টাকা দামের হারভেষ্টর মেশিন সরকারি প্রণদানায় সাড়ে চৌদ্দ টাকায় ক্রয় করে। অর্জন করে একটি বড় ধরনের সম্পদের যৌথ মালিকানা যা সচারচার দেশের গ্রামীর প্রান্তিক ও ছোট কৃষকরা সেভাবে পায় না। কৃষকদের সহযোগিতায় জন্য সরকার নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও সামাজিক বাস্তবতায় গ্রামের সাধারণ কৃষকরা ধরেই নেয় এসব তাদের জন্য নয়, এগুলো কোন না কোনভাবে এলাকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতাবানদের দখলেই যাবে। তাই রাজেন্দ্রপুর কৃষক সংগঠনের এই অসামান্য অর্জন শুধু তাদেরই সাফল্য নয়, এটি গ্রামীন প্রান্তিক কৃষকদের ক্ষমতায়িত করাতে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপেরও অন্যতম সাফল্য।
রাজেন্দ্রপুর কৃষক সংগঠনের স্বপ্নযাত্রা
সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যোগে ২০০৬ সালে রাজেন্দ্রপুর গ্রামের কৃষকদের নিয়ে গঠিত হয় আইপিএম ক্লাব। একটা সময়ে ক্লাবের কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়ে, ক্লাবটি আর সেভাবে সক্রিয় থাকে না। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে ক্লাবের সদস্যদের সাথে সম্পৃক্ত হয় বারসিক। কৃষি সমস্প্রসারণ অধিদপ্তদের দক্ষ উপ-সহকারী কৃষি কর্মকতা ওয়াজেদ আলী ও বারসিকের তত্বাবধানে ক্লাবের কার্যক্রমে গতিশীলতা আসে। গ্রামের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যারোচনা করে দেখা যায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নেত্রকোনা শহরের উপকন্ঠে হওয়ায় গ্রামের কৃষকদের সবজি চাষের মাধ্যমে কৃষকদের স্বাবলম্বি হওয়ার একটি বড় সম্ভাবনা রয়েছে এই গ্রামের কৃষকদের। সেই চিন্তা থেকেই গ্রামের কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হয় সবজি চাষে। সবজি চাষ করতে গিয়ে কৃষকরা বেশ কছিু সমস্যার সম্মুক্ষিণ হয় যার মধ্যে রয়েছে, মান সম্মত কৃষি উপকরণের অভাব, মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও বিষের বিস্তার, উৎপাদিত পণ্যের নায্যমূল্য না পাওয়া ও কৃষি উপকরণের মালিকানা কৃষকের হাতে না থাকা। এই বিষযগুলোকে বিবেচনা করেই কৃষকদের গ্রহীত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টাগুলো বাস্তবায়নে বারসিক ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের যৌথ প্রচেষ্টায় উক্ত সমস্যাগুলো সমাধানে নেয়া হয় বেশ কিছু পদক্ষেপ। যার মধ্যে রয়েছে মান সম্মত বীজ সংরক্ষণে কৃষকদের দক্ষতা উন্নয়ন ও নিজের চাষকৃত ফসলের বীজ নিজেদের সংরক্ষণে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা, রাসায়নিক সার বিষ কীটনাশকের পরিবর্তে জৈব কৃষি চর্চায় কৃষকদের সক্ষমতা উন্নয়নের মাধ্যমে কৃষি উপকরনের উপর কৃষকের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় জৈব কৃষি চর্চায় কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা। এবং নিজেদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিপনন ও নায্যমূল্য নিশ্চিত করতে কৃষকদের সহযোগিতায় কৃষকদের উৎপাদিক কৃষি ফসলের বিপনন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এরই ধারাবাহিকতায় গ্রামের সকল কৃষক নিজ নিজ বাড়িতে শুরু করে ভার্মি কম্পোষ্ট তৈরি ও নিজ জমিতে ব্যবহারের মাধ্যমে জৈব উপায়ে ফসল চাষ । আস্তে আস্তে গ্রামটি এলাকার সকলের কাছে পরিচিত হয়ে উঠে ভার্মি কম্পোষ্ট গ্রাম হিসেবে।
একা নয় সকলকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা
বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের মৃত্যু ঝুঁকি কমাতে যেখানে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির উপর জোর দেয়া হচ্ছে সেখানে রাজেন্দ্রপুর কৃষক সংগঠনের কৃষকরা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। সংগঠনের কৃষকরা শুধু নিজ গ্রামেই এই চর্চা করছে না, তাদের এই চর্চা আশেপাশের গ্রামের কৃষকদেরও নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করছে। বর্তমানে রাজেন্দ্রপুর গ্রামের কৃষকরা আশেপাশের গ্রামগুলোর জৈবচাষে আগ্রহী কৃষকদের জৈব সারের এক বড় যোগানদাতা। সেই সাথে সংগঠনের সদস্যরা জৈব কৃষি চর্চায় আশেপাশের গ্রামের কৃষকদের উব্দুদ্ধ করতে এ বিষয়ক আলোচনা, প্রচারণা ও ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সহযোগিতা করে আসছে। এই করোনা পরিস্থিতিতেও গ্রামের কয়েকজন কৃষক নিজ জমিতে ব্যবহারের পরেও ৩০ মণ ভার্মি কম্পোষ্ট আশেপাশের গ্রামের কৃষকদের সহযোগিতা করেছে। এইভাবে গ্রামের কৃষকরা সম্মিলিতভাবে জৈব কৃষি চর্চার মাধ্যমে এক কৃষি চর্চা অনুশীলন করে চলেছেন।
সংগঠনের সদস্যরা গড়ে তুলেছে সম্পদের যৌথ মালিকানা
সংগঠনের সদস্যসহ গ্রামের কৃষকরা শুধু পারিবারিক কৃষির ক্ষেত্রে জৈব কৃষি চর্চায় অননুশীলনই করে না সেই সাথে সংগঠনের সদস্যরা গড়ে তুলেছে যৌথ মালিকানা ভিত্তিক বিভিন্ন ধরনের সম্পদ। তারা সম্মিলিতভাবে তৈরি করেছে সংগঠনের একটি নিজস্ব ঘর। যেখানে কৃষি নানাবিধ বিষয় নিয়ে নিয়মিতভাবে আলোচনা করে থাকে। বর্তমানে সংগঠনের ঘরটি হয়ে উঠে গ্রামের যেকোন সামাজিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রস্থল হিসেবে। তখন ঘরটি আর ঘরটি আর নিছক কোন অবকাঠামো থাকেনা সেটি হয়ে উঠে গ্রামের মানুষের ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রতীক হিসেবে। এছাড়া গ্রামের কৃষকরা নিজেদের উদ্যোগে গড়ে তুলেছে গ্রামের সকল কৃষকের উৎপাদিত কৃষিপণ্য একত্রিতভাবে বিক্রির জন্য কৃষি বিপণন কেন্দ্র। যা হয়ে উঠেছে কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের নায্যমূল্য নিশ্চিত করতে অধিকার আদায়ের প্রতীক হিসেবে। সদস্যদের যৌথ মালিকানার সম্পদ হিসেবে সর্বশেষ সংযোজন হয়েছে ধান কাটার জন্য হারভেষ্টর মেশিন ক্রয়। সংগঠনের ৪০ জন সদস্য ২৯ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার হারভেষ্টর মেশিন সরকারি ভূর্তকীতে মোট ১৪ লক্ষ ৫০ হাজার টাকায় ক্রয় করে কৃষি উপকরণ হিসেবে মেশিনের যৌশ মালিকানা লাভ করে। নতুন ক্রয় করা মেশিনের মাধ্যমে সংগঠনটি ইতিমধ্যে বোরো মৌসুমে হাওর এলাকায় চরম শ্রমিক সংকটের সময় মোট ১৪০ একর জমির ধান কেটে হাওরের কৃষকদের সহযোগিতা এগিয়ে আসে। এই বছর করোনা পরিস্থিতির কারণে সরকারসহ দেশের মানুষের মধ্যে হাওরের ধান কাটা নিয়ে ছিল এক চরম উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তা। এই চরম সংকটময় মুহুর্তে হাওরের কৃষককের বন্ধু হয়ে ধান কাটার মেশিন নিয়ে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় রাজেন্দ্রপুর কৃষক সংগঠন।
কৃষি থাকবে কৃষকের নিয়ন্ত্রণে, এই স্বপ্নকে ধারণ করেই রাজেন্দ্রপুর কৃষক সংগঠনের যাত্রা শুরু। নানা প্রতিকুলতা পেরিয়ে তারা সেই স্বপ্ন জয়ের পথে এগিয়ে চলেছে। রাজেন্দ্রপুর কৃষক সংগঠনের এই স্বপ্ন জয়ের পথে এগিয়ে যাওয়ার গল্প শুধু তাদেরই সাফল্য নয়। এটি হয়ে উঠতে পারে এদেশের কোটি কোটি প্রান্তিক কৃষককের শক্তি ও সাহস যোগানোর অনুপ্রেরণা।