নিজেদের প্রচেষ্টায় সংকট মুহুর্তেও ব্যস্ত কামার সম্প্রদায়
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
আমাদের দেশের প্রধান পেশা হলো কৃষিকাজ। তাছাড়া মাছধরা, মাটির আসবাব তৈরি, লোহা দিয়ে বিভিন্ন উপকরণ তৈরি এসমস্ত কাজও বহু যুগ আগে থেকেই চলে আসছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যারা এ ধরণের পেশায় যুক্ত থাকেন তাঁদের চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কম থাকে। যে কারণে লোহা বা মাটির উপকরণ তৈরি করে বিক্রি করা তাঁদের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়। প্রাকৃতিক দূর্যোগ বা যে কোনো মহামারীতে তাঁদের কাজ থেমে থাকেনা।
লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের বাইশদার গ্রামে বর্তমানে মাত্র ছয়টি কামার পরিবার বসবাস করে। তাঁদের সবাই বংশ পরম্পরায় এই পেশার সাথে যুক্ত। নিজেদের বাড়ির সামনে ছোট ছোট ঘর তুলে সেখানে বসে তারা কাজ করেন। দা, বটি, শাবল, খুন্তি, কাচি, ছেনি, কুড়াল, কোদাল ইত্যাদি তৈরী করে বাজারে বিক্রি করে তাঁদের সংসার চলে।
বর্তমানে সারা দেশে করোনা নামক রোগটি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। যার আশংকায় গ্রাম থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের মাঝে এক ধরণের আতংক কাজ করছে।
অন্যান্য পেশাজীবি মানুষেরা লকডাউন মেনে বাড়িতে থেকেই সময় কাটাচ্ছে। কিন্তু আমাদের গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এই করোনা পরিস্থিতিতে তাঁেদর সকল কাজকর্ম স্বাভাবিক রেখেছেন। কৃষক যেমন কৃষিকাজে ব্যস্ত তেমনি কামার সম্প্রদায়ের লোকেরাও নিজেদের মতো করে তাঁদের কাজ করে যাচ্ছেন।
লোহার কারিগরদের কাছে বিভিন্ন গ্রাম থেকে অনেকেই এসে উপকরণ তৈরি করে নিয়ে যায়। একদিকে যেমন নিজেদের সংসার চালাতে হবে, তেমনি করোনা থেকে নিজের পরিবার ও গ্রামবাসীদের রক্ষা করতে হবে। এ সকল কারণে তাঁরা নিজেদের সুরক্ষিত রাখা এবং কার্যক্রম চালিয়ে নিতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।
প্রথমত এলাকার যুবরা এই গ্রামে অন্যদের প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। এবং এই গ্রামের কাউকে অন্য গ্রামে যেতে দিচ্ছেনা। কামারদের কাজ করার যে দোকান ঘরটি রয়েছে সেটির চারপাশে রশি দিয়ে বেড়া দিয়েছেন। অন্য গ্রামের কেউ কাজ নিয়ে এলে যাতে এর ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে। এছাড়া প্রতিটি দোকানের সামনে বালতিতে পানি ও সাবান রেখেছেন। যারা কাজের ফরমায়েশ নিয়ে আসবেন তারা যেন হাত ধুয়ে নিতে পারেন।
লোহার কারিগররা সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বিভিন্ন উপকরণ তৈরি করেন। এরপর এলাকার স্থানীয় বাজারগুলোতে তৈরিকৃত সামগ্রী বিক্রির জন্য নিয়ে যায়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাজারে বেচা কেনা চলে। তাই তাঁরা খুব ভোরে উঠে কাজ শুরু করেন। যাতে দুপুরের মধ্যেই বিক্রি করে চলে আসতে পারেন। বাজারে ক্রেতা কম থাকার কারণে উপযুক্ত মূল্যে তাঁেদর উপাদানসমূহ বিক্রি করতে পারছেন।
এখন ধান কাটার মৌসুম চলছে। ধান কাটার একটি অতি প্রয়োজনীয় উপাদান হচ্ছে কাঁচি। এ সময়ে এই উপাদানটি তাঁরা বেশ ভালো দামে বিক্রি করতে পারেন। কিন্তু কাচির আছারি নামক যে অংশটি আছে সেটি কিশোরগঞ্জ থেকে তাঁরা সংগ্রহ করে। সংরক্ষিত আছারি দিয়ে কাচি তৈরি করা শেষ হয়ে যাওয়ায় তারা সমস্যায় পড়ে। বর্তমানে সীমিত আকারে যানবাহন চলার কারণে এগুলো সংগ্রহ করতে পারছেনা। আবার এই সুযোগে যারা আছারি বিক্রি করতো তারাও দাম বাড়িয়ে দেয়। যা আগে প্রতিটি আছারি ২.৫০ টাকায় বিক্রি হতো এখন সেটির দাম বাড়িয়ে বিক্রেতারা ৫টাকা নির্ধারণ করে।
একদিকে উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি অন্যদিকে পরিবহন সমস্যা। তাই এই সমস্যা সমাধানের জন্য তাঁরা অন্য উপায় অবলম্বন করেন। যে পরিমাণ লোহা তাঁদের কাছে মজুদ ছিল তা দিয়ে অন্যান্য উপকরণ তৈরী করে বিক্রি করা শুরু করে এবং ভালো দামও পায়। কাজ করতে গিয়ে লোহার মজুদও ফুরিয়ে যায়। তখন কয়েকজন মিলে নেত্রকোণা শহরের এক লোহা বিক্রেতার সাথে যোগাযোগ করে। নিজেদের সুরক্ষিত রেখে ভোর বেলা অটো ভাড়া করে লোহা সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। সেই লোহা দিয়ে এখন তাঁরা কাঁচি তৈরি করে সংরক্ষণ করছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আছারি কিনবে। অন্যান্য উপকরণ তৈরী ও বিক্রি করা অব্যহত আছে।
বর্তমানে তারা লোহার কাজ পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছেন। সচেতনতার সাথে বাজারে যাওয়া, নির্দিষ্ট দুরত্বে উপকরণ বিক্রি করা, স্বাস্থ্য বিধি মেনে দোকানে কাজ করা অব্যহত রেখেছেন। পাশাপাশি বাড়ির আঙিনায় যাদের সামান্য পরিমাণ জায়গা আছে সেখানে তারা সব্জী চাষ করছেন।
প্রত্যেকেই বিভিন্ন কাজ করার মাধ্যমে মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করে। যে কোনো ধরণের সমস্যাই আসুক না কেন তা মোকাবেলা করার শক্তি, মনোবল নিয়ে এগিয়ে গেলে চলার পথ অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। বর্তমানে এই কঠিন সময়ে সকল শ্রেণি পেশার মানুষেরা নিজেদের মতো করে টিকে আছেন।