উপকূলীয় কৃষকেরা গম চাষে আগ্রহী হচ্ছে
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল লবণাক্ততা এলাকা হিসাবে পরিচিত। সমুদ্রকূলবর্তী এলাকা হওয়াতে এখানে একদিকে যেমন লবণাক্ততা অন্য দিকে তেমনি নানান ধরনরে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সন্মূখীন হতে হয়। লবণাক্ততা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে খাপ খাইয়ে এলাকার মানুষ তাদের জীবনযাত্রার মান সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
অতীতে এলাকাতে নানান ধরনের প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ ছিলো। এলাকাতে চাষ হতো নানান ধরনরে শস্য ফসল। যতদিন অতিবাহিত হয়েছে ততই শস্য ফসলের আবাদ কমে গেছে। লবণাক্ততার কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে বেশির ভাগ জমিতে শুধুমাত্র রোপা আমনই একমাত্র ফসল। এলাকার কৃষকরা সাধারণত দেরিতে পাকে এমন ধান চাষ বেশি করে। আমন ধান কাটার পরে এলাকার অধিকাংশ জমি পতিত থাকে। তবে পুরোটায় নয় আবার কিছু কিছু স্থানে ডাল ও সরিষা চাষ করে। সব কিছুর পরও উপকূলীয় এলাকার মানুষ তাদের জীবন মান উন্নয়নের লক্ষ্যে লবণাক্ততা জমিতে চাষাবাদের জন্য নিরন্তর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। কখন কোন ফসল লাগাতে হবে তা নিয়ে যেন তাদের একপ্রকার গবেষণা চলছে। কখন কোন জমিতে কি ফসল ফলানো যায় তা নিয়ে তাদের চেষ্টার শেষ নেই। কৃষি জমিতে কখনো আমন ধান, কখনো খেসারি, মুগ ডাল ও সরিষা,আলু চাষ । সাথে বসতভিটায় নানান ধরনের সবজি, মসলা চাষ ও করছে।
লবণাক্ততার মধ্যে দিয়ে এবং আমন ধান কাটার পরে জমি যাতে পতিত না থাকে তার জন্য গম চাষের চেষ্টা করেন শ্যামনগর উপজেলার কালমেঘা গ্রামের কৃষক রাধাকান্ত মন্ডল। গত মার্চ মাসে মাঠ পর্যবেক্ষণে তার সাথে কথা হয় যে, এলাকাতে আগে গম হতো না এবছর হঠাৎ করে গম লাগালেন কেন? লাগিয়ে কি মনে হলো? এটা কি লবণ সহনশীল ইত্যাদি বিষয়ে তার কাছে জানার চেষ্টা করা হয়।
এ বিষয়ে রাধাকান্ত মন্ডল বলেন, ‘আমার বয়স হয়েছে ৬২ বছর কোন সময় গম লাগাইনি। এলাকায় যে গম হবে তা জানতাম না। কারণ আমাদের এলাকা তো লবণাক্ততা। শুধুমাত্র বিলে আমন ধান লাগাতাম। যে বছর মিষ্টি পানি থাকতো সে বছর গরমের ধান লাগাতাম। আমন ধান বর্ষার পানি দিয়ে হয় বলে কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু আমন ধান কাটার পর জমিতে লবণ ওঠে। ফলে কোন কিছু হয় না, জমি ফেলে রাখতাম। একদিকে মাটি লবণ অন্যদিকে জমির পাশে চিংড়ি ঘের, পাশে একটা যে পুকুর আছে তার পানিও দুধ নোনতা তা দিয়ে তেমন কিছু হয় না। বারসিক’র যোগাযোগের মাধ্যমে গত বছর থেকে আমাদের গ্রামে উপজেলা কৃষি অফিসের আইএফএম কৃষক মাঠ স্কুল চলমান রয়েছে। সেখানে আমরা স্বামী স্ত্রী দুজনে সেই স্কুলের শিক্ষার্থী। কৃষি অফিস থেকে স্কুল চলমান অবস্থায় বিভিন্ন সহায়তা চলমান রেখেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তারই ধারাবাহিকতায় আমাকে গম চাষ করার জন্য ২০ কেজি গম বীজ সহায়তা করা হয়। প্রথমত আমি গম চাষ করতে চাইনি। তারপরও চিন্তা ভাবনা করে দেখলাম লবণে তো কিছুই হয়না সব সসময় তো নানান কিছু চেষ্টা করি। তা ঠিক আছে একটা বার গম চাষ করে দেখি কিরকম হয়। বিলের অন্য যে জমি আছে সেখানে তো হবে না। তাই বাড়ির পাশে যে ১৩ শতক জায়গা ছিলো সেখানেই কোন অভিজ্ঞতা ছাড়াই প্রথম গম চাষ করি এবং তা মোটামুটি ভালো হয়। প্রায় দেড় মণের মতো হতে পারে। পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা থাকলে হয়তো আরো বেশি ফলন পেতাম। কারণ সেচ দেওয়ার সময় যে বিষয়টা গুরুত্ব দেওয়ার দরকার ছিলো সেটা আমার জানা ছিলো না। যে সেচ দেওয়া পানি এক ঘন্টার বেশি আটকে রাখা যাবে না। এতে অনেক গাছের গড়ায় পানি জমে নষ্ট হয়ে গেছে।’
রাধাকান্ত মন্ডল জানান, এবার থেকে প্রতিবছর গম লাগাবেন। কোন জায়গা ফেলে রাখবেন না। কারণ গম একটু লবণসহনশীল এবং এর সেচও কম লাগে। একটু তদবির করলে ভালো ফলনও হয়। শুধু ধান কেন এবার গমের আটাও খেতে পারবেন বলে তিনি মনে করেন। তাঁর এ গম চাষ দেখে গ্রামে অনেক কৃষক আগ্রহী হয়েছেন। তারা আগামীতে গম চাষ করার কথা জানিয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার লবণাক্ততার মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ জন্য উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত সহিষ্ণু ফসলের জাতের আবাদ বাড়াতে হবে। উপকূলীয় লবণাক্ততা এলাকায় ধান প্রধান ফসল। ধানের পাশাপাশি অন্যান্য ফসল চাষে কৃষককে আগ্রহী ও উদ্যোগী করে তোলা জরুরি।