পরিবেশবান্ধব চুলা চান নেত্রকোনার ঋষিপাড়ার নারীরা
হেপী রায়, খাদিজা আক্তার ও মো: আলমগীর
মালনীর ঋষিপাড়ায় মায়েরা তাদের জীবনের বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতার গল্প বলেন এ অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানে কেউ বলেন তাদের অর্থনৈতিক কষ্ট, সংগ্রামের গল্প, কেউবা আজীবন রান্নাঘরে আবদ্ধ থেকে তাদের দম বন্ধ হওয়ার কষ্টগুলো বলেন। তাঁদের গল্পগুলো বিশ্লেষণে একটি বিষয়ই বার বার ঘুরে ফিরে আসে। সেটি হলো: রান্নার কষ্ট। তাদের গল্পগুলো সংসারের নানান টানাপোড়েনের চিত্র, জ্বালানির সঙ্কট এবং ভালো চুলার জন্য আক্ষেপের ওপর নিবিষ্ট। গল্প বলা শুরু করেন লিপি রাণী ঋষি। তিনি বলেন, “আমরা অভাবী মানুষ। আমরার আবার জীবন কি, গল্পই কি? একটা দিন কাটলে মনে হয় সামনের দিন আবার যুদ্ধ শুরু করতে হইবো। সকালে স্বামীরা বাইরে কাজ করতে যায়। সারাদিন পরে রাতে বাড়ি আসে। আমরা বাড়িতেই থাকি। রান্ধা বাড়া করি, ঘর গোছাই। ছেলে মেয়েরে খাওয়াই, নিজে খাই”। রান্নার প্রসঙ্গ আসতেই তিনি বলেন, “রানতে আমরার অনেক কষ্ট হয়। শহরের ভিতরে থাকলেও আমাদের পাড়ায় গ্যাস নাই। মাটির চুলায় রান্ধি। নিজের বাড়িতে গাছ নাই। স’ মিলের লাকড়ি কিনি। অনেক সময় টাকার অভাবে কম টাকায় ভিজা লাকড়ি কিনতে হয়। সেই লাকড়ি চুলায় দিলে জ্বলেনা। ধোঁয়া হয়। ধোঁয়ার কারণে কাঁশি আসে। মনে হয় না রাইন্ধা যদি খাবার পাওয়া যাইতো, তাইলে এত কষ্ট করতামনা”।
গীতা ঋষি জানান, তাঁর বোনের শ্বাস কষ্ট রোগ ছিল। ধোঁয়া যুক্ত চুলায় দীর্ঘদিন রান্না করতে করতে শ্বাস কষ্ট বেড়ে গিয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। হাসপাতালে রেখেও শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি। অন্যদিকে সুবাসী রানীও রান্না-বান্না করার নানান কষ্টের কথা তুলে ধরলেন। তিনি বলেন,“মাটির চুলায় রানতে রানতেই আমার জীবন শেষ। চোঙ্গা দিয়া ফুঁ দিতে গেলে অহন আর দমে কুলায়না। বুকে ব্যথা লাগে। বয়স হইছে। তিনবেলা রানতে পারি না। ছেলের বৌ রান্না করে।” তিনি বলেন, “শুনছি একরকম চুলা কিনতে পাওয়া যায়, যে চুলায় ধোঁয়া হয়না। কিন্তু আমরার এমন অবস্থা নাই যে হাজার টাকা খরচ কইরা চুলা কিনবাম। যদি ধোঁয়া কম হয় এমন চুলা আমরা নিজেরা বানাইতে পারতাম তাইলে আমরার উপকার হইতো”।
উপস্থিত আর এক নারী মিনা ঋষি অনুন্নত চুলায় রান্নার পরিণতির কথা জানান। তিনি বলেন, “চুলার ধোঁয়ায় আমার সারা শরীরে চুলকানি হইছে। অন্যসময় কম থাকে। কিন্তু যখনই চুলার সামনে থাকি আগুনের তাপে চুলকানি বাইড়া যায়। কত অষুধ খাই। কিন্তু একবারের জন্যেও কমে না।” গল্প বলার আসরে প্রতিটি নারীই কমবেশি রান্নার কষ্টের কথা তুলে ধরেছেন। শহরের নিকটবর্তী হওয়া স্বত্তেও সকল ধরণের নাগরিক সুযোগ সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত। অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে তাদের জীবনের চাহিদাও সংকীর্ণ হয়ে গেছে।
মায়েদের গল্প বলার পাশাপাশি শিশুদের চিত্রাংকন প্রতিযোগিতাও হয় ওই অনুষ্ঠানে। বিষয়টিও মায়েদের গল্পগুলোর সাথে সামঞ্জস্যতা রয়েছে। চিত্রাংকণ প্রতিযোগতায় ঋষিপাড়ার ৩০ জন শিশু ও কিশোর কিশোরী অংশগ্রহণ করে। চিত্রাংকণের বিষয়বস্তু ছিল বাড়ির পরিবেশ, আঙিনা, চুলায় রান্নারত নিজের মায়ের ছবি। প্রতিযোগিরা নিজের কল্পনায় বাড়ির পরিবেশ ও মায়ের ছবি আঁকে। বিভিন্ন রঙের সাহায্যে ফুটিয়ে তোলে তাদের কল্পনার ছবি।