হোগলা
:: শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে জেসমিন আরা ::
হোগলা গাছের দৈর্ঘ্য মাটির উপরে প্রায় ৭৬ থেকে ৯০ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং প্রস্থ প্রায় এক ইঞ্চি। শেকড় মাটির গভীরে প্রায় ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি যায়। গোড়ার শেকড় অনেকটা কচু গাছের শেকড়ের মতো। গাছের গোড়ায় কচুর “ব” এর মতো “ব” আছে। এই “ব” হেটে যেদিকে দাঁড়ায় সেখানে গাছের জন্ম হয়। পাতার দৈর্ঘ্য ৭৬ ইঞ্চি এবং প্রস্থ আধা ইঞ্চি। কাচা বেলায় পাতার রঙ গাঢ় সবুজ। পাতা শুকিয়ে গেলে কাঠ রঙ হয়। পাটের মতো বা মেলের মতো হোগলা কেটে পানিতে জাগ দিয়ে রোদে শুকিয়ে ব্যবহার উপযোগী করতে হয়। মাটির প্রকৃতি এটেল। মিষ্টি ও দুধ নোনতা পানিতে জন্মে। প্রাকৃতিক নিয়মে হোগলার বংশবিস্তার এক রকম আর চাষ করতে হলে হোগলা ধান গাছের মতো রোপণ করতে হয়। একটি করে কয়না লাগিয়েই সেখান থেকে হোগলার বন করে তোলা সম্ভব।
“এই গ্রামে আগে হোগলা কোথাও ছিল না। এখন অবশ্য কয়েকজনের জমিতে আছে। ২ থেকে ৩ বছর পূর্বে আমন মৌসুমে চাষের জন্য আমি কালীগঞ্জ থানার দুদলী গ্রাম থেকে ২৩ ধানের পাতা কিনে নিয়ে আসি। ওই ধানবীজ পাতার মধ্যে অনাকাঙ্খিতভাবে হোগলার একটি “কয়না” থেকে যায়; যা কারো চোখে পড়েনি। গোছা করে ধান পাতা রোপণের সময় অজান্তে রোপণ করা হয়ে যায় হোগলা কয়না। প্রকৃতির মাঝে কোনো কিছুই গোপনীয় থাকে না। একটা সময় তা মানুষের দৃষ্টিগোচর হয়। একটি কয়না থেকে একটি গোছ আর তা থেকে বন তৈরি হয়েগেছে। ৪ বিঘা জমিতে ধান লাগিয়ে আমি প্রায় ৫০ মণের উপরে ধান পেতাম কিন্তু সেবার আমার প্রায় ১০ কাঠার মতো জমির ধান নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ধান যখন এক থেকে দেড় হাত লম্বা হয় হোগলা তখন ২-৩ হাত লম্বা হয়, যা ধান চাষের জন্য ক্ষতিকর। তবে হোগলা বন মাছ চাষের জন্য খুবই নিরাপদ যাকে বলে মাছের অভয়াশ্রম। মাছ চুরি হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে না। হোগলা বনের মধ্যে মাছ থাকার জন্য “পতন বা আলা” (মাছ দলবদ্ধভাবে থাকার জন্য ছোট খাদ্য) তৈরি করে। মাছ ধরতে গেলে এর মধ্যে গিয়ে গা ঢাকা দেয়। হোগলার সাথে মাছ চাষ ভালো হয়। তবে মাছ ধরতে খুবই ঝামেলা পোহাতে হয়। হোগলা পাতা কেটে জাগ দিয়ে শুকিয়ে “নাড়া” (খড়) এর মতো করে ছোট ছোট “নুসিগোল্লা” (একগোছা করে খড় একসাথে আটি বাঁধা) করে ঘর ছেয়েছিলাম। টিন কিংবা এ্যাসবেসটস দিয়ে ঘরের ছাউনি করতে গেলে প্রায় ১০,০০০ টাকা খরচ পড়তো। আরও হতো কি গরমের দিনে ঘর গরম হতো, শীতের দিনে প্রচন্ড ঠান্ডা! কিন্তু হোগলা দিয়ে ছাউনি করাতে এরকম কোনো সমস্যাই হয়নি। পরিবেশের সাথে মানানসই ও পরিবেশবান্ধব, স্বাস্থ্যপোযোগী এবং দীর্ঘস্থায়ী। হোগলা পাতা দিয়ে জ্বালানী করেছি কয়েক মাসের। হোগলার ‘জড়’ মারার জন্য পাশের মানুষদের কেটে নিতে দিয়েছি। তারা প্রায় ৬ মাসের জ্বালানী করেছে। উপরোক্ত কথাগুলো বলেন মঠবাড়ি গ্রামের কৃষক আবুল বাশার। তিনি আরও বলেন, “হোগলা দিয়ে অনেক কিছু (চাটাই, ঠোঙা, পাটি) বানানো যায় শুনেছি কিন্তু আমরা জানিনা। আমার ধান চাষের ক্ষতি হয় দেখে অনেকবার মেরে ফেলতে চেয়েছি আবার কখনও উপড়ে ফেলতে চেষ্টা করেছি। কখনও কেটে ফেলে নতুন মাটি দিয়েছি তাতেও কোন ফল হয়নি। প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া, প্রকৃতিই সাহায্য করছে হোগলার “পত্তন” বাড়তে। চাইলেই তাকে মারা সম্ভব হচ্ছে না।
বছরে দু’বার ফুল ধরে। চৈত্র-বৈশাখে একবার আর ভাদ্র-আশ্বিন মাসে একবার। “মাইজ” এর মধ্য থেকে কচুর ফুলের মত ফুল বের হয়। ধীরে ধীরে ফুল বড় হতে থাকে। ফুলের দৈর্ঘ্য প্রায় ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি। প্রস্থ দুই থেকে আড়াই ইঞ্চি। ফুলের ডাটা শক্ত। ফুলের রঙ প্রথমে সাদাটে এবং ফুলের গায়ে “কুড়ো” থাকে। ফুল যখন “পোক্ত” অর্থাৎ পুষ্ট হয়ে আসে তখন রঙ হয় হলুদ লালচে। গায়ে কোন কুড়ো থাকে না। ফুল পাকলে গাঢ় ঘিয়ে রঙ ধারণ করে। ফুল দেখতে অনেকটা পাকড়ার তুলার মতো তবে পাকড়ার তুলার থেকে আকারে বড় এবং লম্বাকৃতির। ফুলের গায়ের তুলা শরতের মেঘের মতো সাদা ধবধবে। পুষ্ট হয়ে যাওয়া ফুল গাছে থাকা অবস্থায় রোদ ও বাতাস পেলে ফেটে তুলা ছড়িয়ে যায় বাতাসে। তখন মনে হয় যেন সাদা মেঘ ভেসে যাচ্ছে। কলার মোচা যেভাবে সংগ্রহ করতে হয় গাছ থেকে ঠিক তেমন করেই তুলাসহ ফুলটা সংগ্রহ করতে হয়। এরপর নেটে বেঁধে অথবা বস্তায় ভরে রোদে শুকাতে হয়। ঠিক যেভাবে পাকড়া তুলা শুকানো হয়। তা না হলে ফেটে গিয়ে বাতাসে তুলো উড়ে চলে যায়। ফুল রোদে শুকিয়ে তুলা ছাড়িয়ে ভেতরে “থোড়” টাকে আলাদা করে রাখা হয়। তুলা হয় সাধারণত “শিমূল, পাকড়া কিংবা কাপাসের”। আর বালিশও তৈরি হয়ে থাকে সাধারণত এ সমস্ত তুলা থেকে। কথায় বলে,“শিমূল তুলার কোমল বালিশ।” সেও এই তুলার তৈরি বালিশের নিকট হার মেনে যায়। “পাকড়া, শিমূল কিংবা কাপাস” তুলার তৈরি বালিশে কিছুদিন পরে তুলা জমাট বাঁধে। কিন্তু এই তুলার তৈরি বালিশে তুলা জমাট বাঁধে না। খুবই মিহি তুলা এবং বালিশ হয় খুবই নরম ও মোলায়েম। ব্যবহারে খুবই আরামদায়ক। চাইলে যে কেউ এটা দিয়ে “তশোক”ও তৈরি করতে পারে। এই তুলা যে ফুল থেকে তৈরি সেটা আর অন্য কোন গাছের নয় শ্যামনগর উপজেলার মঠবাড়ি গ্রামের কৃষক আবুল বাশারের স্যালোচালিত চিংড়ি, সাদামাছ ও ধান চাষের চার বিধা জমির ঘেরে অনাকাঙ্খিতভাবে জন্ম নেওয়া “হোগলার বুনো ফুলের”। বর্তমানে তার বাড়িতে যতগুলো বালিশ আছে তা সবই হোগলা ফুলের তুলা থেকে তৈরি। নিজের বাড়ি ছাড়াও যত আত্মীয়স্বজন আছে প্রত্যেককে দু-চারটি করে বালিশ দিয়েছেন। শ্যামনগর উপজেলা ব্যতিত দেবহাটা, ঝিনাইদহ-যশোর পর্যন্ত গেছে এই বুনো ফুলের তুলার বালিশ।
প্রকৃতির সাথে উদ্ভিদ ও প্রাণবৈচিত্র্যের আছে এক নিবিড় সম্পর্ক। সব প্রাণবৈচিত্র্যের বাস্তুসংস্থান প্রকৃতি। সম্পর্কের শিকলে আবদ্ধ একটার সাথে একটা প্রাণ। সময়ের বিবর্তনে অনেক কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির মাঝ থেকে। আবার জন্ম নিচ্ছেও অনেক প্রাণবৈচিত্র্য, যা আামদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে জড়িত। প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া ও বেড়ে ওঠা এসব প্রাণের প্রতি যতœবান হওয়া জরুরি। সবার উদ্যোগী ভূমিকা রক্ষা করতে পারে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যকে।