সাম্প্রতিক পোস্ট

হেমন্তেই মরা খাল মানিকগঞ্জের বৃহত্তর ৪ নদী

আব্দুর রাজ্জাক, মানিকগঞ্জ থেকে  

পদ্মা ও যমুনার মতো বড় দু’টি নদী ছাড়াও মানিকগঞ্জের বুক চিড়ে প্রবহমান ছিল ৯টি শাখা নদী। এ ছাড়াও জালের মতো ছড়িয়ে ছিল অসংখ্য খাল আর বড় বড় বিল। মানিকগঞ্জ জেলার অন্যতম নদীগুলো হচ্ছে পদ্মা, যমুনা, ইছামতী, কালীগঙ্গা, কান্তাবতী, মনলোকহানী, গাজীখালী, ক্ষীরাই, মন্দা, ভুবনেশ্বর, ধলেশ্বরী। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি নদী অস্তিত্ব হারিয়েছে। শুকিয়ে যাওয়া বেশির ভাগ খাল-বিলই ভরাট করে পরিণত হয়েছে জনপদ-স্থাপনা। যেগুলো টিকে আছে বর্ষা মওসুম ছাড়া প্রায় সবগুলোই থাকে পানিশূন্য। যতদূর চোখ যায়, নদীর বুকজুড়ে ধূধূ বালুচর, কোথাও চাষাবাদ- গরু চরানো- বালু ব্যবসায়ীদের হুলস্থুল তৎপরতা কিংবা দুরন্ত কিশোরদের খেলার দৃশ্য চোখে পড়ে। পদ্মা, যমুনা নদী ছাড়া সব নদীই এখন মৃতপ্রায়। দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এগুলো নদী না কি মরা খাল?

নাব্যতা হারিয়ে ফেলায় নদী ও খাল-বিলগুলো বর্ষার পানি ধারণ করতে পারে না। ফলে পানি সহজেই ঢুকে পড়ে লোকালয়ে। আর বাড়িঘর, জনপদ আর ফসলি জমি ভাঙনের শিকার হয়ে ফি বছরই বদলে যাচ্ছে জেলার মানচিত্রের অবকাঠামো। একদিকে নদী, খাল-বিল দখল করে ভূমিদস্যুরা তুলছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বালু-মাটি আর অন্যদিকে কারখানার বর্জ্য আগ্রাসন। অর্থাৎ দখল-দূষণে বিপর্যস্ত সার্বিক পরিবেশ-প্রকৃতি। নদী ও খাল-বিলে পানি নেই তো মাছও নেই। জেলে সম্প্রদায়ের পেট বাঁচাতে বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে নদী তীরবর্তী কৃষিতে সেচের ব্যবস্থা। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এসব বিশাল বিশাল চরের মানুষগুলো খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মৌলিক অধিকার বঞ্চিত হয়েই জীবন কাটাচ্ছেন অতি কষ্টে-যন্ত্রণায় আর হাহাকারে। শুধু প্রাণ আর জলের জন্যই নয়, নদী-খাল-বিলের করুণ মৃত্যু ঝুঁকিতে ঝুঁকতে থাকায় বিশাল পরিবর্তন এসে গেছে মানিকগঞ্জের আর্থ-সামাজিক অবস্থায়ও। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, মানিকগঞ্জ জেলার মাঝ দিয়ে বয়ে চলা দেশের প্রধান দুই নদী পদ্মা, যমুনা ছাড়াও ধলেশ্বরী, পুরনো ধলেশ্বরী, কালীগঙ্গা, ইছামতি নামে চারটি নদী রয়েছে। ১৩৭৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মানিকগঞ্জ জেলায় এসব নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪১ কিলোমিটার।

বিগত তিন দশকে পদ্মার ভাঙনে হরিরামপুর উপজেলার লেছড়াগঞ্জ, সুতালরী, পাটগ্রাম, হারুকান্দী, আজিমনগর ও বয়রা ইউনিয়নের অধিকাংশ আবাদি জমি বিলীন হয়ে গেছে। পদ্মার বুকে মানিকগঞ্জের সীমানায় বেশ কয়েকটি বড় বড় চর জেগে উঠেছে। নদীভাঙনে এই উপজেলার অর্ধেক মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। দৌলতপুর উপজেলার পশ্চিম সীমান্তঘেঁষে প্রবাহিত হয়ে শিবালয় উপজেলায় যমুনা নদী পাটুরিয়া ঘাটে এসে শেষ হয়েছে। এর দৈর্ঘ্য ৪০ কিলোমিটার। একসময় যমুনার ভাঙনে বিলীন হওয়া দৌলতপুর উপজেলার চরকাটারি, বাঁচামারা, বাঘুটিয়া ও জিয়নপুর ইউনিয়নের কমপক্ষে ২০/২৫টি গ্রাম গত ২০ বছরে আবার জেগে উঠেছে। শিবালয় উপজেলার শিবালয় ও তেওতা ইউনিয়নসহ দৌলতপুরের এই চারটি ইউনিয়নের অধিকাংশ ভূখন্ডই এখন যমুনার চর। উন্মত্ত যমুনার বুকজুড়ে অসংখ্য বড় বড় চড় জেগে ওঠায় হেমন্তের শুরুতেই ইমেজ সংকটে দেশের অন্যতম বৃহত্তর এ নদীটি।

টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলায় যমুনা নদী থেকে ধলেশ্বরী নদীর উৎপত্তি। সেখান থেকে এই নদী মানিকগঞ্জের ঘিওর ও সাটুরিয়া উপজেলার মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীটি সিংগাইর হয়ে বুড়িগঙ্গায় মিশেছে। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০ কিলোমিটার। এই নদীটিও মৃতপ্রায়। বর্ষা মৌসুম ছাড়া বছরের অধিকাংশ সময় নৌকা চলাচলের মতো পানিও থাকে না। ধলেশ্বরীর শাখা কান্তাবতী, মনলোকহানী, ক্ষীরাই, মন্দা ও ভুবনেশ্বর নদীর এখন আর অস্তিত্ব নেই। পুরান ধলেশ্বরী নদী দৌলতপুর উপজেলার মূল যমুনা থেকে শুরু হয়ে ঘিওর উপজেলার জাবরা এলাকায় এসে শেষ হয়। এর দৈর্ঘ্য ২৬ কিলোমিটার।
manikgonj-river-pic
ধলেশ্বরীর আরেকটি শাখা নদী গাজীখালি একসময় স্রোতস্বিনী থাকলেও বর্তমানে ক্লিনিক্যালি ডেড-এ পরিণত হয়েছে। মানিকগঞ্জ জেলায় সাটুরিয়া উপজেলার গোপালপুর হয়ে গাজীখালী নদী দরগ্রাম, সাটুরিয়া, গাঙ্গুটিয়া, সুয়াপুর, রোয়াইল, ইউনিয়ন পাড় হয়ে ঢাকা জেলার সাভারের বংশী নদীতে পতিত হয়েছে। প্রায় ৫০ কিলোমিটার বিস্তৃত এ নদীতে বছরের ৮/৯ মাসই পানি শুন্য থাকে। সেই সুযোগে স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখল করে নিয়েছে নদীটির বিশাল এলাকা। দখলকৃত জায়গায় কেউ বাড়িঘর নির্মাণ করে আছে, কোথাও আবার দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে, কেউ নিয়মিত চাষাবাদ করে নদীর অবশিষ্ট চিহ্নটুকু মুছে ফেলছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সুত্রে জানা যায়, ২০১২ সালে গাজীখালী নদীর উৎসমূখে এক কিলোমিটার এলাকা খনন করা হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ শিডিউল অনুযায়ী কাজ হয়নি বিধায় তখনকার খননে মূলত কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
দৌলতপুরের কাছে যমুনা থেকে কালীগঙ্গা নদীর উৎপত্তি হয়ে জাবরা কোল ঘেঁষে সিঙ্গাইরের ধল্লা পর্যস্ত এ নদীটির বিস্তৃতি। এর দৈর্ঘ্য ৪৫ কিলোমিটারের ওপরে। বর্তমানে এই নদীর অধিকাংশ স্থানে শুকনো মৌসুমে নৌকা চলার মতো পানিও থাকে না। কোথাও কোথাও একেবারেই শুকিয়ে গেছে। চলছে বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ। গুমড়ি খেয়ে পরেছে বালু ব্যবসায়ীরা। পদ্মার শাখা নদী ইছামতী হরিরামপুর উপজেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ফের পদ্মায় মিশেছে। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৯০ কিলোমিটার। ভাঙন ঠেকাতে প্রায় ১৭ বছর আগে যাত্রাপুরের কাছে বাঁধ দেওয়া হয়। বর্তমানে এটি মৃতপ্রায়। কেবল বর্ষা মৌসুমে একটা সরু ধারা প্রবাহিত হয়।
একই অবস্থা মানিকগঞ্জে খাল-বিল ও জলাশয়গুলোরও। মানিকগঞ্জ শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত খালটিতে বছর কুড়ি আগেও সারাবছর পানি থাকত। শুকিয়ে গেছে প্রাচীন অতি পরিচিত কাশাদহ খাল। পদ্মার সঙ্গে সরাসরি সংযোগ ছিল এই খালের। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান খালটি খনন করেছিলেন। তারপরও খালটির নাব্যতা রক্ষা সম্ভব হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মানিকগঞ্জে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হয়েছিল গোলাইডাঙ্গার খালে। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে হানাদার বাহিনীর সাতটি নৌকা ডুবে গিয়েছিল। অথচ সেই গোলাইডাঙ্গার খাল এখন পায়ে হেঁটে পার হওয়া যায় অনায়াসেই। মানিকগঞ্জের বাস্তার বিল, ভাতছালার বিল, গজারির বিল, বৈরাগীর বিল, পটল বিল, বানিয়াজুরী কালী লতার ডাঙ্গা, নয়াকান্দির কুম, আয়নাপুরের বিল আজ কেবলই স্মৃতি।

কালের বিবর্তনে নদীপথ হারিয়ে ফেলেছে তার অস্তিত্ব ও জৌলুস। নদী মাতৃক বাংলাদেশ কালপরিক্রমায় ধীরে ধীরে ধাবিত হচ্ছে মরুময়তার দিকে। অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ এবং উজান থেকে আসা বালুমাটিতে এসব নদী ভরাট হয়ে ধূধূ চরাঞ্চলে পরিণত হয়েছে। এসব নদী খনন না করায় দেশীয় মাছ বিলুপ্তির পথে। ফলে কয়েক হাজার মৎস্যজীবী পেশা বদল করে মানবেতর জীবনযাপন করছে। নদী মরে যাওয়ার ফলে সেচকাজ দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এক সময় কালীগঙ্গা নদী তীরবর্তী বেউথা ঘাট, ধলেশ্বরী নদীতে জাগির ব্রিজ সংলগ্ন ও জাফরগঞ্জ বাজার ছিল জেলার সবচে’ বড় নদীবন্দর। পানির অভাবে মানিকগঞ্জের সব নদীবন্দর তার কার্যক্রম হারিয়ে ফেলেছে।
মানিকগঞ্জের বিশিষ্ট সাংবাদিক ও প্রভাষক সাইফুদ্দিন আহমেদ নান্নু অনেকটা আবেগের সুরে জানালেন মানিকগঞ্জের নদীর ইতিকথা। নদীর এ করুণ মৃত্যুকে মাতৃশোকের সমতুল্য মনে করে তিনি বলেন, “এখনো সময় আছে, নদীগুলোকে বাঁচানোর। যথাযথ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় এসব নদী পুরোপুরি হারিয়ে গেলে তা হবে এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক ও প্রাণবৈচিত্রের জন্য এক ভয়াবহ বিপর্যয়। ভরাট হওয়া নদীগুলো খননের দাবি এখন “প্রাণের দাবি” মানিকগঞ্জবাসীর।” দৌলতপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোহাম্মদ মছির উদ্দিন জানান, চরাঞ্চলের প্রায় ২০০ হেক্টর জমিতে পলি ও দোআঁশ মাটিতে গম, বাদাম, মিষ্টিআলু, সবজিসহ বিভিন্ন প্রকার ফসল চাষাবাদ হচ্ছে।

মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মুজিবর রহমান বলেন, “নদী পুনঃখনন না করায় মৎস্য উৎপাদন, কৃষি ও পরিবেশবান্ধব নৌকার ব্যবহার মারাতœভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ২০১১-১২ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে গাজীখালী, যমুনা ও কালিগঙ্গার বালিরটেক এলাকায় নদীতে কিছু খননের কাজ হয়েছে। এ ছাড়া আরো খননের জন্য জলবায়ু  ট্রাস্ট ফান্ড বরাবর একটি প্রকল্প দাখিল করা হয়েছে।” মানিকগঞ্জ পরিবেশ অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক মামুন উর রশিদ বলেন, “মানিকগঞ্জে প্রবহমান নদীগুলো মরে যাওয়ায় তাপমাত্রা বৃদ্ধি, কৃষি, মৎস্য, জীববৈচিত্রসহ সর্বত্র এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে মারাত্মক পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটার আশংকা রয়েছে।”

happy wheels 2