মানিকগঞ্জে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামীন খেলাধুলা
মানিকগঞ্জ থেকে আব্দুর রাজ্জাক
আধুনিকতার বেড়াজাল, হাতের মুঠোয় বিশ্ব, আর ক্রিকেট, ফুটবলের ধ্বকলে মানিকগঞ্জে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামীণ খেলাধুলা। দুঃখজনক হলেও সত্য একসময় বইয়ের পাতাতেও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না আমাদের জাতীয় খেলা হাডুডুসহ অন্যান্য গ্রামীণ খেলাগুলোকে। শৈশবের সুন্দর দিনগুলোতে শিশু কিশোররা এখন চোখ রাখে মনিটরে, টিভি পর্দায় কিংবা স্মার্টফোনে। আর খেলা বলতেই তারা বোঝে ক্রিকেট, ফুটবল।
মানিকগঞ্জে গ্রাম বাংলার সংস্কতি আর ঐতিহ্যের ধারক ডাংঙ্গুলী, কাবাডি, দাঁড়িয়াবাধা, গোল্লা ছুট, বউ পুতুল, কানামাছি, কুতকুত, হাড়ি ভাঙ্গা, বৌ ছি, রুমাল চুরি, ইচিং বিচিং, চোর ডাকাত, ওপেন্টিং বায়োস্কোপ, কপাল টোকা, খুঁটি মুচি, মার্বেল, বরফ পানি, লাটিম খেলা, সাত চাড়াসহ অসংখ্য খেলা এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। হয়তো দু’এক প্রজন্ম পরেই এসব খেলা হয়ে যাবে কেবলই গল্প।
আমাদের জাতীয় খেলা হাডুডু বা কাবাডির উৎপত্তিস্থল ফরিদপুর, আবার মতান্তরে কেউ কেউ বলেন বরিশাল। বাংলাদেশের সর্বত্রই এই খেলার প্রচলন রয়েছে। ৪২ ফুট লম্বা ও ২৭ ফুট চওড়া মাঠ লাগে হাডুডুর জন্য। মাঠকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। সাধারণত খেলোয়াড় থাকেন ১২ জন। তবে প্রতিবার সাত জনের দল নিয়ে খেলতে হয়। খেলা শুরু হলে একপক্ষ দম রেখে হাডুডু, কাবাডি..কাবাডি..কিংবা টিক টিক. . . বলতে বলতে ডাক দিতে থাকে এবং মধ্যরেখা পার হয়ে বিপক্ষের কাউকে ছুঁয়ে দম থাকা অবস্থায় দ্রুত পালিয়ে আসতে চেষ্টা করে। যদি কাউকে ছুঁয়ে আসতে পারে তবে সে ‘মরা’ বলে গণ্য হয়। আবার আক্রমণকারী যদি বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের হাতে ধরা পড়ে, তবে সেও মরা বলে গণ্য হয়। যদি মরা দলের কেউ প্রতিপক্ষের কাউকে ছুঁয়ে আসতে পারে তবে মরা পুনরায় বেঁচে যাবে। বিভিন্ন অনুষ্ঠান কিংবা বর্ষা মৌসুমে গ্রামে আয়োজিত এখেলা দেখতে দর্শকদের হুড়োহুড়ি লেগে যেত।
লাঠি খেলা এদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী ভ্রাম্যমাণ পরিবেশনা শিল্প। গ্রামের সাধারণ মানুষেরা তাদের নৈমিত্তিক জীবনের উৎসব-বাংলা বর্ষবরণ, বিবাহ, অন্নপ্রশান ইত্যাদি অনুষ্ঠান উপলক্ষে লাঠি খেলার আয়োজন করতেন। ব্রিটিশ শাসনামলে অবিভক্ত বাংলার জমিদাররা (পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বঙ্গ) নিরাপত্তার জন্য লাঠিয়ালদের নিযুক্ত করত। এই খেলার জন্য ব্যবহৃত লাঠি সাড়ে চার থেকে পাঁচ ফুট লম্বা, তৈলাক্ত হয়। অত্যাশ্চর্য কৌশলের সঙ্গে প্রত্যেক খেলোয়াড় তাদের নিজ নিজ লাঠি দিয়ে রণকৌশল প্রদর্শন করে। লাঠিয়াল বাহিনী সড়কি খেলা, ফড়ে খেলা, ডাকাত খেলা, বানুটি খেলা, বাওই জাঁক, নড়ি- বারী খেলা এবং দাও খেলার পাশাপাশি বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ঢোলক, কর্নেট, ঝুমঝুমি, কাড়া ইত্যাদি ব্যবহৃত হয় এবং সঙ্গীতের সাথে চুড়ি নৃত্য দেখানো হয়।
বাংলার সব গ্রামের কিশোর-কিশোরীদের জনপ্রিয় খেলাগুলোর মধ্যে গোল্লাছুট অন্যতম। বৃত্ত তৈরি করে ঘুরতে হয় বলে একে ‘গোল্লা’ এবং আঞ্চলিক ভাষায় ‘ছুট’ হলো দৌড়ানো। এভাবেই খেলার নাম হয়েছে গোল্লাছুট। গ্রামের বিস্তৃত স্কুল মাঠ, খোলা জায়গা, নদীর পাড়ে সাধারণত কিশোর-কিশোরীরা গোল্লাছুট খেলায় মেতে ওঠে। গোল্লাছুট খেলায় দু’টি দল থাকে। মাটিতে এক জায়গায় গর্ত করে একটি লাঠি পুঁতে তাকে কেন্দ্র হিসেবে ধরা হয়। এই লাঠিকে কেন্দ্র করে বৃত্ত তৈরি করে ২৫/৩০ ফুট দুরের কোন একটি বস্তুকে (বৃত্তের বাইরে আর একটি কেন্দ্র) স্পর্শ করতে হয়। ওই গোল্লা থেকে দৌড়ে সীমানাকে ছোঁয়াই খেলার প্রধান লক্ষ্য। দু’দলেই সমান সংখ্যক খেলোয়াড় থাকে (৫ অথবা ৭ জন)। দলনেতাকে ধরে ঘুরতে থাকা খেলোয়াড়রা ফাঁক বুঝে দৌড় দিয়ে সীমানাকে ছুঁতে চেষ্টা করে। আর অপরপক্ষ ছুটে চলে দৌড় দেয়া খেলোয়াড়কে সীমানা ছোঁয়ার আগে ছুঁয়ে দিতে।
এগুলো ছাড়াও লাটিম খেলা, বৌ ছি, কানামাছি গোল্লা ছুট, দাঁড়িয়াবাধা খেলাও একসময় ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু কালের আবর্তে এসব খেলার দৃশ্য এখন আর তেমন চোখে পড়ে না।আশির দশকের মানিকগঞ্জের জনপ্রিয় হাডুডু খেলোয়াড় লিয়াকত আলী খান বলেন, “আগে গ্রামীণ খেলাধুলা মানুষের মনকে নির্ভেজাল আনন্দ দিত। খেলোয়ারদের মূল্যায়নও করতো। এসব জনপ্রিয় খেলা উপভোগ করতে আগে মানুষের ঢল নামতো। কিন্তু গ্রামীণ খেলা এখনকার শিশু কিশোররা চেনেই না।”
কম্পিউটার মনিটর, টিভি পর্দা, স্মার্টফোন, ক্যারাম, ক্রিকেট, ফুটবলের জনপ্রিয়তার রাহুগ্রাসে নির্ভেজাল গ্রামীণ এসব বিনোদন মাধ্যম এখন কালের আবর্তে হারিয়ে যেতে বসেছে। আমাদের আদি সংস্কৃতির শেকড় টিকিয়ে রাখতে হলে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানকে এখনই পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন ক্রীড়া ব্যক্তিত্বরা।