ইচ্ছাশক্তির কাছে হার মানলো সকল প্রতিবন্ধকতা
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে মারুফ হোসেন মিলন ও বিশ্বজিৎ মন্ডল
ঈশ্বরীপুর ইউনিয়নের ধুমঘাট গ্রামের কেওড়াতলী পাড়ার দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থী হারুর অর রশিদ। পড়াশুনা করার তীব্র বাসনা। কিন্তু উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রধান এবং একমাত্র প্রবিন্ধকতা পরিবারের অর্থনৈতিক দুরবস্থা। তবুও শিক্ষা কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টা।
বাবার সম্পত্তি বলতে ১৫ শতক ভিটেবাড়ি; তাও আবার খাস। অর্থাৎ নিজেদের কোন জমিই নেই। বাবা শেখ হাতেম আলি (৭৫) একজন দিন মজুর। সংসারে মা বাবা ও ভাই বোন মিলে ৪ জন সদস্য।
ছোট বেলা থেকে রশিদের পড়াশুনার উপর আগ্রহটা একটু বেশি। তাই পিতার আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকলেও রশিদ নিজের শ্রম ও চেষ্টা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো। কখনো জন-মজুরি দেওয়া, কখনো টিউশনি করা, কখনো অন্যের সহায়তা নিয়ে। ২০১৪ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বন্দেকাটি আহমাদিয়া দাখিল মাদ্রাসা থেকে এ গ্রেড পান। ২০১৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিকেও একই প্রতিষ্ঠান থেকে এ গ্রেড পান।
এরপর রশিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়ার জন্য বাড়িতে বসে তো আর সুযোগ পাওয়া যাবে না। তাই কোচিং করার জন্য খুলনা যেতে চান। কিন্তু রশিদের বাবা খরচ চালাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এ কথা শুনে রশিদের মন খারাপ হয়ে যায়। ছেলের অবস্থা দেখে রশিদের বাবা অবশেষে বাড়িতে ৩টি গরু ছিল তার মধ্যে ২টি গরু বিক্রি করে ও সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে খুলনায় কোচিং এর জন্য পাঠান। এরপর ভর্তির জন্য রশিদ খুলনা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরম উঠান এবং ভর্তি পরিক্ষায় অংশ নেন। অবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খ ইউনিটে ইসলামের ইতিহাসে মেধা তালিকায় অবতীর্ণ হয় রশিদ।
এই আনন্দের খবর রশিদের কাছে আনন্দের মনে হয়নি। যখন জানতে পারলো যে ভর্তি হওয়ার জন্য এখনো পনের হাজার (১৫০০০) টাকা লাগবে। সে টাকা কিভাবে সংগ্রহ করবে? রশিদসহ পিতা-মাতা সবাই দুশ্চিন্তার সাগরে পড়লো। বাড়িতে তো বিক্রি করার মতো আর কিছুই নেই। অনেকের কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা চাইলেও কোন সুফল পাওয়া যায়নি। তখন তার পিতা মাতা আরো বেশি ভেঙে পড়েন। পিতা হাতেম আলি দুঃখ করে রশিদকে বলেন, “আমাদের মতো পরিবারের সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আশা করা কোনদিন স্বপ্নেও ভাবা উচিৎ নয়।” রশিদও একেবারে ভেঙে পড়েন এতো দুর এসে আর যেতে পারবো না।
সৌভাগ্যক্রমে ৮ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে সুন্দরবন স্টুডেন্ট সলিডারিটি টিমের মুন্সিগঞ্জ ইউনিটের সাইফুল ইসলাম ও বিভাস চন্দ্র মন্ডলের সাথে স্বাক্ষাৎ হয় রশিদ এবং তার পরিবারের। স্বাক্ষাতে রশিদ ও তার বাবা মা বলেন, “তোমরা তো সবার জন্য অনেক কিছু করো, আমাদের জন্য কি কিছু করতে পারবা আগামী ১৫ নভেম্বর ভর্তির শেষ তারিখ’।” সব শুনে মুন্সিগঞ্জ ইউনিটের সদস্যরা জানান, তারা কি করতে পারবে সে বিষয়ে রশিদ ও তার বাবা মাকে জানাবেন। এরপর তারা সদর ইউনিটকে অবহিত করে।
সদর ইউনিট সভাপতি মারুফ হোসেন মিলনকে ১০ নভেম্বর রশিদের বাড়িতে যান এবং তার পিতা মাতা ও রশিদের সাথে বিস্তারিত কথা বলেন। পরবর্তীতে টিমের সদস্যদের নিয়ে সভা আয়োজন করেন। টিমের সদস্যরা বলেন, “যে করে হোক রশিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। আমরা দরকার হলে আমাদের টিম থেকে চাঁদা উঠিয়ে তাকে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেবো।” এরপর টিমের সভাপতি তার পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডা: নাজমুন নাহারকে সব বিষয় বিস্তারিত বলেন। তিনি রশিদের ভর্তির জন্য সব রকমের সহযোগিতার আশ্বাস দেন ও রশিদকে তার সাথে যোগাযোগ করার কথা জানান। এরপর রশিদের সাথে পরিচয়ও করিয়ে দেন টিমের সদস্যরা। অবশেষে হারুন অর রশিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিও হতে পারেন। তার ভর্তি পরবর্তী পড়ার সব রকমের সহায়তা কথা জানান শিক্ষক ডা. নাজমুন নাহার।
বর্তমানে রশিদ দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র। রশিদের পদচারণায় মুখরিত হোক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। পূরণ হোক তার জ্ঞান পিপাসু বাসনা। এখানেই রশিদের গল্পের শেষ নয়; বরং শুরু। তাকে যেতে হবে আরো অনেক দূর। প্রতি পদে পদে তার প্রযোজন পড়বে আর্থিক সহযোগিতার। আমাদের শুভ কামনা রইল রশিদের সাথে। আর্থিক সমস্যা যেন কখনোই তার পড়াশুনার অন্তরায় না হয়।
আমরা এও বিশ্বাস রাখি রশিদ তার চলার পথে এসএসএসটি. (সুন্দরবন স্টুডেন্ট সলিডারিটি টিম) বা ডা. নাজমুন নাহার মতো হাজারো মানুষ এবং প্রতিষ্ঠানের দেখা পাবেন। যাদের একটুখানি মানবিক সহায়তায় রশিদের মতো মেধাকে বাঁচাতে এবং সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা এবং অনুপ্রেরণা যোগাবে।