লোকায়ত পদ্ধতি ও জ্ঞান : সমস্যা সমাধানে অব্যর্থ উপায়
কলমাকান্দা, নেত্রকোণা থেকে অর্পণা ঘাগ্রা
প্রকৃতির চিরচেনা রূপ সবসময় চেনা রূপে থাকেনা। সেই অচেনা রূপে অনভ্যস্ততার কারণে মানুষ অনেকসময় হোঁচট খায়। তবে তাই বলে থেমে থাকে না তাদের জীবন ও উদ্ভাবনী মানসিকতা। প্রতিকুল পরিস্থিতিতে অভিযোজন করার জন্য সম্পূর্ণ নিজের মতো করে নতুন নতুন কৌশল আয়ত্ব করেন টিকে থাকার তাগিদে। পরিবেশ ও প্রতিবেশগত ভিন্নতার কারণে ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের মানুষের টিকে থাকার প্রেক্ষাপট ভিন্ন ধরনের। এই ভিন্নতার কারণেই বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের জীবন জীবিকাকে কেন্দ্র করে যেসব সংস্কৃতি রয়েছে সেখানেও কিছু না কিছু ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। সেই রকমই খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রেও রয়েছে কিছু ভিন্নতা। এখানে সবজি উৎপাদনের ক্ষেত্রে একই পদ্ধতির ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়েছে।
হাওর অঞ্চল
কলমাকান্দা উপজেলার বরখাপন ্ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রামই হাওর অধ্যূষিত। হাওরাঞ্চলে বছরের ৬-৭ মাস পর্যন্ত বসতভিটের চারপাশ পানি থাকে। সঙ্গে বড় বড় আফাল (ঢেউ) থাকে। প্রতিবছর বসতভিটে রক্ষার্থে মাটি ভরাট করে আবার আফালের সময় মাটি ক্ষয়ে যায়। তাই এই সময় বসতভিটের আয়তনগুলো ছোট হতে থাকে। কোন সবজি চাষ করার মত পর্যাপ্ত জায়গা থাকে না। এই রকম প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেই পারিবারিক খাদ্য চাহিদা মিটানোর তাগিদে সুধানন্দ দাস (৪৫) সবজি চাষ করছেন ‘টাওয়ার বেড’ পদ্ধতিতে।
এই পদ্ধতিতে সবজি চাষ করার জন্য প্রথমে বাঁশ দিয়ে ৪ ফিট উচ্চতার গোলাকার বেড়া তৈরি করা হয়। তারপর প্লাস্টিক দিয়ে চারপাশ পেঁচিয়ে দেওয়া হয়-যেন মাটি আঁটকে থাকে। প্লাস্টিকের বিভিন্ন জায়গায় ৫ ইঞ্চি পরিমাণ কেটে দেওয়া হয়। প্লাস্টিকের প্রতিটি কেটে দেওয়া অংশে পরবর্তীতে একেকটি সবজির চারা রোপণ করা হয়। বেড়া সব থেকে নিচের স্তরে দুই বস্তা নারকেলের ছোবরা তার উপরের স্তরে দুই বস্তা কচুিরপানা ও দুই বস্তা গোবর মিক্সড করা মাটি দেওয়া হয়। এছাড়াও তিন কোনায় বড় বড় ৩টি পাইপ স্থাপন করে তাতে সুরকি দিয়ে ভরাট করে পাইপটি উঠিয়ে ফেলা হয়। সুরকি দেওয়া হয়েছে যেন পানি দেয়ার সময় প্রত্যেকটি স্তরে পানি ধীরে ধীরে সমান ভাবে ছড়ায়। এই টাওয়ার বেডে সুধানন্দ দাশ এ বছর ১০-১৫টি ছেড়া অংশ ও উপরের অংশে ৭ জাতের বারোমাসী মরিচ, ২ জাতের বেগুন, ২ জাতের টমেটো, লাউ, মিষ্টিকুমড়া প্রভৃতি রোপণ করেছেন।
টাওয়ার বেডের উপকারিতা সম্পর্কে সুধানন্দ দাস বলেন, “এই পদ্ধতি আমি শিখেছিলাম হিলিপ থেকে। এই পদ্ধতিতে সবজি চাষ করলে বন্যার সময় কোন ক্ষতি হবে না। ছোট জায়গায় সব ধরনের সবজি চাষ করা যায় সারাবছর ধরে। হাওর অঞ্চলের জন্য এই পদ্ধতি খুব উপকারী।” একই গ্রামের সন্ধা রানী দাস (৩২) সারাবছর সবজি চাষ করেন বস্তা পদ্ধতিতে। বস্তায় সবজি চাষের সুবিধা সম্পর্কে তিনি বলেন, “বর্ষাকালে ভিটার চারপাশে পানি আইলে সবজি চাষ করার জায়গা থাকে না। তাই বস্তায় সবজি চাষ করলে পানি বেশি হইলে বস্তায় উঁচু জায়গায় রাখা যায়। পানি কমে গেলে মাটিতে নামিয়ে দেয়া যায়। আবার শীতকালে মাটি গর্ত করে বস্তাসহ গর্তে পুঁতে রাখা যায়। তবে মাঝে মাঝে বস্তায় গোবর সার দিতে হয়।” তিনি আরো বলেন, “এভাবে সারাবছর ধরে নিজের খাওয়ার লাইগ্যা সবজি চাষ করতে পারি। বিক্রি কইরাও বাড়তি কিছু আয় করতে পারি। পাড়া পড়শীদেরও দিতে পারি। শীতকালে আমাদের সবজি কিনতে হয় না। বর্ষাকালেও খুবই কম কিনতে হয়। যে টাকা দিয়া সবজি কিনতাম হেই টাকা অন্য কাজে লাগাইতে পারি।”
সমতল অঞ্চল
নাজিরপুর ইউনিয়নটি সমতল ও জলাবদ্ধ এলাকা। এই ইউনিয়নের রহিমপুর গ্রামের অদিবাসী শামছুন্নাহারের (৩২) বসতভিটের পরিমাণ ১৪ শতাংশ। স্বামী একজন সবজি বিক্রেতা। এই ছোট্ট বসতভিটের মধ্যেই প্রায় ২ শতাংশ পরিমাণ জমিতে রয়েছে ছোট্ট একটি পুকুর। এই পুকুর পাড় ছাড়া সবজি চাষ করার মত তার জায়গা নেই। কিন্তু এখানেই তিনি সবজি চাষ করেন সারাবছর। কিন্তু এই পুকুরের দুই তৃতীয়াংশ জায়গা আবার গাছের ছায়ায় ঢাকা এবং পুকুরের পাড় উচু না হওয়ায় প্রতিবছর বর্ষাকালে পানিতে ডুবে থাকে। তাই তিনি বস্তায় সবজি চাষ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বস্তায় চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি বলেন, “বস্তায় সবজি চাষ করা খুবই সোজা। প্রথমে গোবর আর মাটি মিক্স করে রাইখা দিই। কয়েকদিন পর গোবর মিক্স করা মাটি বস্তায় ভরে রৌদ কিছুটা লাগে এমন জায়গায় রাইখা দিই। পরে কয়েক জাতের বীজ পুঁতে দিই। চারা বড় হইলে মাঁচা দিই।” তিনি আরও বলেন, “আমার তো জায়গা নাই। তাই পুকুরের উপর মাঁচা করতে হয়। এই এক মাঁচাতেই শীতকাল ও বর্ষাকালে সবজি করি। বর্ষাকালে পুকুর পাড়ে পানি আইসা গেলে বস্তা উচু জায়গায় রাইখা দিই। আর পানি কমে গেলে মানে শীতকালে মাটি গর্ত করে বস্তা সহ রাইখা দিই।” এই ছোট্ট জায়গাতেই তিনি লাউ, শিম, মিষ্টি কুমড়া চাষ করেছেন। এখান থেকে তার পারিবারিক সবজি চাহিদা মিটে গিয়ে কিছু বিক্রি করে বাড়তি আয়ও করছেন এবং প্রতিবেশীদের মধ্যেও বিনিময় করছেন।
পাহাড়ি অঞ্চল
শুধুমাত্র হাওর কিংবা সমতল অঞ্চলের জনগোষ্ঠীই বস্তায় সবজি চাষ করে না। পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত কৃষককেও বস্তায় সবজি চাষ করার প্রয়োজন পড়ে। সীমান্ত অধ্যূষিত চন্দ্রডিঙ্গা গ্রামের কৃষক সুকুমার হাজং প্রতিবছর তার ঘরের পেছনের জলাবদ্ধ জমিতে বস্তায় সবজি চাষ করেন। তার ২ কাঠা পরিমাণ জমির দুই দিকে বসতভিটে ও বড় বড় গাছপালা থাকায় এই জায়গাটি জলাবদ্ধ থাকে। শীতকালে এই জমিতে সবজি চাষ করতে পারলেও বর্ষাকালে পতিত রাখতে হয় তাকে। তাই নিজ উদ্যোগেই বস্তায় সবজি চাষ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তার এই জমিতে প্রচুর কাদামাটি থাকায় সরাসরি বস্তা কাদামাটিতে রাখা সম্ভব হয় না। তাই আরো কিছুটা কৌশলী হয়েছেন। প্রথমে তিনি কলাগাছ কয়েক ইঞ্চি পরিমাণ কেটে ২-৩টি ধাপে কলা গাছের ফালিগুলো একটির উপর আরেকটি বসান এবং তার উপর বস্তা বসান। বস্তায় সবজি চ্াষের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তিনি বলেন, “বস্তায় সবজি চাষ করাতে এখন আমি এই জমিতে সারাবছর সবজি চাষ করতে পারি। এর আগে বর্ষাকালে জমিটা পতিত থাকতো। আমার খুব আফসোস হতো। এখন সারাবছর আমার সংসারে সবজির জন্য খুব কম খরচ হয়।”
আপাত দৃষ্টিতে কৃষকদের এই পদ্ধতিগুলো ক্ষুদ্র মনে হলেও যারা এসবের উপকারভোগী তারা এর গুরুত্ব উপলব্ধি করেন অত্যন্ত গভীরভাবে। কারণ এটি তাদের দৈনন্দিন খাদ্য চাহিদা পূরণে ব্যপক ভূমিকা রাখছে। পাশপাশি প্রতিকুল পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে চলতে তাদেরকে সক্ষম করে তুলছে।