আর নয় বাল্যবিবাহ
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
নেত্রকোনা সদর উপজেলার সাজিউড়া গ্রামের অত্যন্ত দরিদ্র এক পরিবারের মেয়ে আকলিমা আক্তার (১৮)। পরিবারের ৬ ভাই-বোনের (৪ বোন ২ ভাই) মধ্যে আকলিমা তৃতীয়। ভাই-বোনের সকলেই লেখাপড়া করে। বাড়িভিটাসহ তার পিতার মোট জমির পরিমাণ ৫০ শতাংশ। একমাত্র পিতার সামান্য উপার্জনে (কৃষি কাজ ও কৃষি শ্রমিক) ৮ সদস্য পরিবার অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করে। পারিবারিক অভাব অনটনের দরুণ আকলিমা অষ্টম শ্রেণীতে পড়াশুনারত অবস্থায় তার বাবা তার বিয়ে ঠিক করেন। কিন্তু আকলিমা এ বিয়েতে রাজি হয়নি।
গ্রামের সমবয়সী মেয়েদের ঐক্যবদ্ধ করে শপথ গ্রহণ করে যে, তারা কেউ বাল্যবিবাহ করবে না। গ্রামের সমবয়সী ৫ জনকে মেয়েকে নিয়ে নেত্রকোনা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে ব্লক প্রিন্ট, বাটিক, ব্যাগ, শোপিজ তৈরির উপর ৬ মাস মেয়াদী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এবং প্রশিক্ষণের পর প্রথমদিকে সে নিজের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস তৈরি করে। তার হাতের কারুকার্যের প্রশংসা দিন দিন এলাকা ও এলাকার বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্নজন তার কাছে ব্লক প্রিন্ট, বাটিক, ব্যাগ, শোপিজের মালামালের জন্য অর্ডার দিতে থাকে। গ্রাহকের অর্ডার অনুযায়ী সে সেগুলো তৈরি করে বিক্রি করতে থাকে। একাজ থেকে যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে সে নিজের পড়াশুনা খরচ ও অন্যান্য প্রয়োজনে খরচ করে। এভাবে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে এবং অনেক কষ্ট সত্ত্বেও আকলিমা তার পড়াশুনা বন্ধ রাখেনি।
সে বর্তমানে ময়মনসিংহ আনন্দমোহ কলেজে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে অর্নাস তৃতীয় বর্ষে পড়ছে। তার বান্ধবী ৫জনের মধ্যে কেউ অনার্স আবার কেউ মার্ষ্টাসে পড়ছে। আকলিমা নিজেকে নিয়েই শুধু ভাবে না, তার মতো গ্রামের অন্যসব মেয়েদের নিয়েও তার অনেক ভাবনা। বাল্যবিবাহ রোধে সে প্রাণপণ চেষ্টা করে, নিজ চেষ্টায় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ব্যর্থ হলে গ্রামের সচেতন গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সহযোগিতা নেয়। এভাবে গ্রামের সচেতন মহলের সহযোগিতা নিয়ে সে এ যাবৎকাল পর্যন্ত ৪টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে।
আকলিমা সমাজ থেকে বাল্য বিবাহ বন্ধের জন্য প্রচারণা ও উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপশি গ্রামের দরিদ্র ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের বিনামূল্যে লেখাপড়ায় (প্রাইভেট পড়া) ও হাতের কাজ শিখতে সহযোগিতা করে। সে নিজ বাড়ির চারপাশে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ, হাঁস-মুরগি, গরু ও ছাগল পালন করে। এসব প্রাণীসম্পদ দেখভাল করতে তার মা তাকে সহযোগিতা করে। সবজি ও গবাদি পশু-পাখির আয় দিয়ে তার অন্য দুই ভাই-বোনের পড়াশুনার খরচ ও সংসারের খরচ চলে।
আকলিমা নিজ উদ্যোগে সাজিউড়া মফিলা উচ্চ বিদ্যালয়ে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে প্রচারণা পরিচালনা এবং শিক্ষার্থীদেরকে বাল্যবিবাহ বন্ধে ও বাল্যবিবাহ না করার জন্য শপথ গ্রহণ করায়। গ্রামের অভিভাবকদের নিয়ে বাল্যবিবাহ বন্ধে ও নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে জন সচেতনতা বৃদ্ধিতে সে নিয়মিত সভার আয়োজন করে। এ ধরনের সভায় স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি (মেম্বার) ও কাজীসহ গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তি ও অভিভাবকগণ অংশগ্রহণ করেন। সভায় আকলিমা তার নিজের ও অপরাপর পাঁচ বান্ধবীর জীবনী নিয়ে আলোচনা করে নারী শিক্ষা বৃদ্ধিতে উদ্বুদ্ধ করছে।
আকলিমা আক্তার সাজিউড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মনীষীদের জীবনী নিয়ে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করে। চলতি মাসে সে ৪৫ জন শিক্ষার্থীদের সাথে বেগম রোকেয়া’র জীবনী (বেগম রোকেয়া’র জন্ম ও নারী শিক্ষায় তার অবদান) নিয়ে আলোচনা করে নারী শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করছে। আকলিমা বলেন, ‘বেগম রোকেয়ার জন্য আজ আমরা পড়াশুনা করতে পারছি।’ এভাবে বেগম রোকেয়া’র জীবনী সম্পর্কে এবং তার নিজের জীবন নিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করে। আকলিমা অন্যান্য সাধারণ মেয়েদের থেকে ভিন্ন রকমের। সামাজিক সচেতনতা ও অন্যান্য বিষয়ে সে নিজে উদ্যোগ নিয়ে কাজ করে। গ্রামের ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের জন্য বিভিন্ন ধরনের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করে।
শিশুরা মানসম্মত পড়াশুনা, নিজস্ব গ্রামীণ সংস্কৃতি চর্চা ও নিজেকে জানার লক্ষ্যে সাধারণ জ্ঞানের প্রতিযোগিতা, বানান লিখন প্রতিযোগিতা, চিত্রাংকন, গ্রামীণ খেলাধূলা ও সংবাদপত্র পাঠসহ নিজেকে সঠিকভাবে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় সমূদয় বিষয় নিয়ে কাজ করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। আকলিমা আক্তার বলেন,“আমার এই স্বপ্ন ছড়িয়ে পড়ুক বাংলাদেশের সকল যুবতীদের মাঝে।”
আমাদের দেশের নারীরা বর্তমানে অনেক দূর এগিয়েছে। শিক্ষার পাশাপাশি সকল ক্ষেত্রে নারীদের বিচরণ এখন লক্ষ্যণীয়। সকল ক্ষেত্রে নারীরা তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা উপস্থাপনে সক্ষম হচ্ছে। কিন্তু গ্রামীণ অঞ্চলে এখনও নারীরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রতিকূলতার মূখোমূখি হচ্ছেন। বিশেষভাবে বাল্যবিবাহ, যৌতুক, নারী নির্যাতন, ইভটিজিং, শিক্ষার সুযোগের অভাব, আর্থিক অনটন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে আশার কথা হলো যে, গ্রামে এখনও আকলিমা ও তার বান্ধবীদের মতো বেশকিছু মেয়ে তাদের অধিকার তথা নারী অধিকার বিষয়ে সোচ্চার। আমরা আশা করি প্রতিটি গ্রামে আকলিমাদের মতো মেয়েরা নারীদের অধিকার সুরক্ষায় প্রচারণা অব্যাহত রাখবে এবং সকল শ্রেণীর মানুষ তাদের অধিকার সুনিশ্চিতকরণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিবে। গড়ে উঠবে শোষণ, নির্যাতন ও বঞ্চনামুক্ত সমাজ এবং নারী-পুরুষ ভেদাভেদ ভূলে সকলে পারস্পারিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে আন্তঃনির্ভরশীল পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখবে।