সুন্দরবনের মধু বৈচিত্র্য

সুন্দরবনের মধু বৈচিত্র্য

সাতক্ষীরা থেকে রামকৃষ্ণ জোয়ারদার

বিশ্বের একক বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনের অজস্র সম্পদের মধ্যে অন্যতম মধু বৈচিত্র্য। সুন্দরনের মোট মধুর দুই-তৃতীয়াংশ পাওয়া যায় উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালীনী রেঞ্জে। মৌসুমে সুন্দরবনের খলিসে, কাঁকড়া, লতা, জানা, কেওড়া, গরান, বাইন ও গেওয়া গাছে অসংখ্যা ফুল ফোটে এবং ঐসমস্ত গাছের ডালে মৌমাছিরা অসংখ্য মৌচাক তৈরি করে। এই মৌচাকগুলো মোয়ালীরা খুঁজে বের করে মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করে।

মধু সংগ্রহ কৌশল
বনজীবী মৌয়ালীরা বন বিভাগের ‘পাস’ নিয়ে মৌয়ালীরা বিজোড় সংখ্যা ৯ জন ১১ জন ও ১৩ জনের দল নিয়ে নৌকাযোগে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের জন্য যাত্রা শুরু করে। মৌয়ালীরা সপ্তাহে ৬ দিন (শুক্রবার বাদে) সুন্দরবনের মধ্যে মধু সংগ্রহ করে। দিনে দু’বার তারা বনের মধ্যে মধু সংগ্রহের জন্য যায়। সকাল বেলা ভাত খেয়ে ৭টার দিকে বনে প্রবেশ করে এবং দুপুর ১২টার মধ্যে ফিরে আসে। আবার ২ টার দিকে বনে যায় এবং বিকাল ৫ টার দিকে ফিরে আসে।

Ram

মৌয়ালীরা প্যান্ট, শার্ট ও প্লাস্টিক জুতা পরে বনের মধ্যে প্রবেশ করে। বনের মধ্যে তারা ৫/৬ জনে ৬০ থেকে ৭০ ফিট দূরত্ব বজায় রেখে মৌচাকের সন্ধান করেন। একজন মৌয়ালী দা, ধামা ও একটি লম্বা লাঠি বহন করেন। সারিবদ্ধভাবে মৌচাক সন্ধানকে তাঁরা ‘ছাটা দেওয়া’ বলেন। যখন কোন একজন একটি মৌচাক দেখতে পায়, তখন ‘কু’ শব্দ করে অন্যদের খবর পৌছে দেয়। এরপর সবাই মৌচাকের কাছে একত্রিত হয়। এসময়, বনের মধ্য থেকে কিছু কাচা ও শুকনা গাছের পাতা লাঠির মাথায় বেঁধে তাতে আগুন জ¦ালিয়ে মৌচাক থেকে মৌমাছি তাড়ানোর জন্য ধোয়া সৃষ্টি করে। এ লাঠিকে তারা ‘কাড়–’ বলেন। যখন মৌচাক থেকে মৌমাছি উড়ে যায়, তখন একজন মৌয়ালী দা নিয়ে গাছের মাথায় উঠে চাকের মধু অংশ কেটে দেন এবং আরেক জন গাছের নিচে ধামা পেতে ধরে নেন। মৌয়ালীদের মতে যিনি গাছে উঠে মধু কাটে তাকে ‘কাটনী বাবলে’ বলেন। মৌচাকের বাকী অংশ তারা যতœ সহকারে গাছের ডালে সংরক্ষণ করে যাতে আগামী বছর তা থেকে আবার মধু সংগ্রহ করতে পারেন। মৌচাকের সংরক্ষিত অংশকে তারা ‘ঢার’ বলেন। মৌসুমে তারা একটি মৌচাক থেকে ৮/৯ বার মধু সংগ্রহ করতে পারে।

বিখ্যাত খলিসা মধু যেখানে বেশি পাওয়া যায়
সুন্দরবনের দক্ষিণ পঞ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল, দোবেঁকী, তালপাটি, খাজুরদানা, কস্তুরখালী, আঁঠারবেকী, লতাবেকী, কাছিঘাটা, ডিঙ্গিমারি ও কলাগাছি প্রভৃতি স্থানে প্রচুর পরিমাণে খলিসের মৌচাক ও মধু পাওয়া যায়। মৌয়ালীদের মতে, সুন্দরবনের খলসী ফুলের মধু সুগন্ধি, খুব স্বাদ, ওজন বেশি, রঙ সাদা এবং দাম বেশি।

খলিসা গাছ কমে যাওয়ার কারণ
সুন্দরবন সংলগ্ন শ্যামনগর উপজেলায় কৈখালী, মুন্সিগঞ্জ, বুড়িগোয়ালিনী, গাবুরা, আঁটুলিয়া, কাশিমাড়ি ও রমজাননগর ইউনিয়নের মোট মৌয়ালীর সংখ্যা পায় ৪২,৩৯৬ থেকে ৪৯,৪৬২ জন (সুত্র: বন বিভাগ, বুড়িগোয়ালীনী রেঞ্জ,সাতক্ষীরা)। উপকূলীয় এলাকার লোকেরা জ্বালানির জন্য গরান, বাইন, গামো, খলিসা গাছ কাটেন। অন্য গাছের জ্বালানির সাথে সাথে খলিসা গাছ কেটে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করছেন। বন বিভাগ থেকে জীবিত গাছ জ্বালানি হিসাবে কাটা নিষেধ। অনেক বনজীবী জানেন না খলিসা গাছ থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত মধু পাওয়া যায়। সে গাছ অনেক বনজীবী কাঁচা কেটে রেখে আসেন তারপর সপ্তাহ দুই পরে গিয়ে বনবিভাগের সাথে বলে তাদের কিছু এ শুকনা জ্বালানি সংগ্রহ করেন। এভাবে সুন্দরবন থেকে খলিসা গাছ হারিয়ে যাচ্ছে ( সুত্র: স্থানীয় বনজীবী মৌয়ালীরা)। সুন্দরবনে যদি খলিসা গাছ হারিয়ে যায় তবে সুন্দরবনের খলসী ফুলের সুগন্ধি মধুর স্বাদ আর কোন মধু থেকে পাওয়া যাবে না।

Ram1

মধু সংরক্ষণ কৌশল
বনজীবী মৌয়ালীরা সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহের পর বনের মধ্যে ধামাতে (বেতের তৈরি পাত্র) সংরক্ষণ করেন। ধামাকে তারা ‘আড়ি’ বলেন। এভাবে বনের মধ্যে মৌচাকে ধামা পরিপূর্ণ হলে একজন মৌয়ালী তা নৌকায় বড় পাত্রে রেখে যান। এরপর সুন্দরবন থেকে মৌচাক সংগ্রহের পর মৌয়ালীরা তা থেকে মধু বের করার জন্য মৌচাক ধারালো দা নিয়ে এমনভাবে কয়েকটি টুকরা করেন যা সহজে দু’হাতের মধ্যে ফেলে চাপ দিয়ে মধু বের করতে পারেন। মধু চাপ দিয়ে তারা প্রথমে একটি বড় হাড়ি বা গামলায় জমা করেন। পরে তা পরিস্কার নেট দিয়ে ছেকে প্লাস্টিক ড্রামে ভরে রাখে। এভাবে তারা সংগৃহীত মধু সংরক্ষণ ও বিশুদ্ধ করেন এবং মোম একটি বস্তায় সংরক্ষণ করে। মৌয়ালীদের সংগৃহীত মধু স্থানীয় বাজার ছাড়াও বিভিন্ন মাধ্যমে সাতক্ষীরা, খুলনা, যশোর, ঢাকা ও দেশের অন্যান্য স্থানে চলে যায়। মধু সংগ্রহের মৌসুমে একজন মৌয়ালী ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা আয় করতে পারেন।

সুন্দরবনের মধুসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের স্থায়িত্বশীল সংরক্ষণ ও ব্যবহারে বনজীবী মৌয়ালীদের প্রথাগত জ্ঞানের কোন বিকল্প নেই। সেজন্য, সচেতন নাগরিক, সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বনজীবী মৌয়ালীদের ঐতিহ্যিবাহী পেশা টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি মধু বৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধশীল করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

happy wheels 2

Comments