দুর্যোগকালিন খাদ্য গড় আলু

রাজশাহী  থেকে ব্রজেন্দ্রনাথ

দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলটি ভৌগোলিকভাবে অন্যান্য অঞ্চল থেকে আলাদা। ভৌগোলিক কারণেই এই অঞ্চলেটির মানুষ নানা দুর্যোগের সম্মুখীন হন প্রতিবছর। বিশেষ করে পানি সঙ্কট ও খরা একটি নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফাল্গুন, চৈত্র্য ও বৈশাখ মাসে এ অঞ্চলে খরা প্রকট আকার ধারণ করে। মাঠে, ঘাটে থাকে না কোন শস্য-ফসল। দরিদ্র মানুষেরা খাদ্য সঙ্কটে পড়ে। অন্যদিকে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস হওয়ার কারণে প্রকৃতিতেও আগের মতো খাদ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়ে উঠে না। IMG_1111ফলশ্রুতিতে অনাহারে, অর্ধাহারে দিনাতিপাত করতে হয় দরিদ্র ও প্রকৃতিনির্ভর মানুষগুলোকে। বরেন্দ্র অঞ্চলে বসবাসরত সাঁওতাল, পাহাড়িয়া, পাহান, মুন্ডা, ওরাঁও, মাহাতো আদিবাসীরা সবচে’ বেশি সঙ্কটে পড়েন এই সময়। কেননা ফসল ফলানোর সুযোগ না থাকায় সে সময় কাজও থাকে না। কারণ বেশির আদিবাসীই দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। যাদের জমি-জমা আছে তারাও ফসল ফলাতে না পেরে খাদ্য সঙ্কটে পড়েন। আদিবাসী ছাড়াও অনেক দরিদ্র মানুষ রয়েছে যারা কাজ করতে না পেরে পরিবারের খাদ্য সঙ্কটে পড়েন।

তবে আদিবাসীসহ বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষেরা এই পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম। নিজের বাঁচার জন্য, টিকে থাকার জন্যই তাদেরকে পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়া হয়েছে। তাই খাদ্য সঙ্কট মোকাবেলায় তাঁরা বাড়ির আশপাশে নানা ধরনের প্রকৃতিতে পাওয়া বিভিন্ন অচাষকৃত উদ্ভিদের চারা রোপণ করেন। প্রকৃতিতে পড়ে থাকা বিভিন্ন ধরনের আলুসহ অন্যান্য অচাষকৃত উদ্ভিদ সংরক্ষণ ও যতœ করে তারা দুর্যোগকালীন সময়ে নিজেদের খাদ্য সঙ্কট নিরসন করার চেষ্টা করেন।
IMG_1115
এভাবে দেখা গেছে, রাজশাহীর পবা উপজেলার ভুগরোইল গ্রামে প্রায় ৫০টি পাহাড়িয়া আদিবাসী পরিবার খাদ্য সংকট মোকাবেলায় গড় আলুর চাষ করেন। দীর্ঘদিন ধরে এই আলু চাষ করেছেন তারা। এই প্রসঙ্গে আলু চাষী ক্লেমেন্তিনা বিশ্বাস বলেন, “আমি যে আলুগুলো চাষ করি সেগুলোর নাম হচ্ছে গড় আলু, সাদা আলু, তিন পাতা আলু। এই আলুর অনেক জাত বনে জঙ্গলেও হয়ে থাকে।” তিনি আরও বলেন, “২০১৪ সালে লালপুর আত্মীয়র বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে দেখি এই আলুগুলো বাড়িতে ঘরের পাশে বা পরিত্যাক্ত জায়গায় চাষ হচ্ছে। আমি বীজ সংগ্রহ করে ২০টি বীজ বাড়ির আশেপাশে, বেড়ার ধারে, বাড়ির পেছনে দেওয়ালের ধারে লাগিয়েছি।” তিনি জানান, এই আলু লাগানোর জন্য আলাদা করে কোন প্রকারের বাড়তি জায়গার প্রয়োজন পড়ে না। এই আলুর বীজগুলো জ্যৈষ্ঠ মাসে রোপণ করা হয়। বীজ বপনের ৭দিন পরেই চারা বের হয়।

সুরভি বিশ্বাসও এই আলু চাষ করেন। তিনি বলেন, “আজ থেকে প্রায় ৮ বছর আগে পাবনায় আমার বাবার বাড়িতে গড় আলুর ২ কেজি বীজ নিয়ে আাসি। এই বীজগুলো নিয়ে আসার পর আমি গ্রামের ৬ জন নারীর মধ্যে বিতরণ করেছি।” সুরভি বিশ্বাস জানান, এই গড় আলু আগে বন জঙ্গলে পাওয়া গেলেও এখন বন-জঙ্গল কমে যাওয়ায় খুব একটা দেখা যায় না। বনজঙ্গল পরিষ্কার করে কেউ জমি তৈরি করছে কেউবা ফলের বাগান করছে বিধায় দিন দিন এই গড় আলু হারিয়ে যাচ্ছে বলে তিনি জানান। এ প্রাকৃতিক খাদ্যটি রক্ষার জন্য তাঁরা তাই নিজেদের বসতভিটায় চাষ করছেন বলে জানান। IMG_1120

ওমরপুর গ্রামের কৃষাণী মোসাঃ মোনোয়ারা বেগমও এই আলু চাষ করেন। তিনি  বলেন, “গড় আলু আমি ৩ বছর ধরে টালা (মাচা) করে চাষ করে আসছি। ৩ বছর আগে আমার বোনের বাড়ি থেকে এক কেজি বীজ নিয়ে এসে চাষ করতে শুরু করি।” তিনি আরও বলেন, “আমি এই গড় আলু চাষ করে বেশ উপকার পেয়েছি। প্রথম বছর চাষ করে ১৫ কেজি গড় আলু পেয়েছিলাম। আমার সবজি চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি উদ্বৃত আলু বাজারে বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছি।” তিনি জানান, দুর্যোগের সময় এই আলু খুব কাজে আসে।

সুরভি বিশ্বাস, ক্লেমেন্তিনা বিশ্বাস ও মোনায়ারা জানান, এই আলু চাষের ফলে সবজির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যায়। দরিদ্র মানুষের হাতে সবসময় টাকা ও পয়সা থাকে না; তাই অনেকসময় অনেকে খাদ্য কিনে খেতে পারেন না। সেক্ষেত্রে গড় আলু দুর্যোগের সময় দরিদ্র মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণ করে বলে তারা জানান।

happy wheels 2