কার্বন ট্রেডিং

এবিএম তৌহিদুল আলম

বিশ্বে কার্বন ট্রেডিং বা কার্বন বাণিজ্য ধারণার সূত্রপাত হয়েছে ১৯৯৭ সালে কিয়োটো প্রটোকল স্বাক্ষরের পর। প্রচলিত মতে, কার্বন ট্রেডিং এর উদ্দেশ্য হলো শিল্পের অগ্রগতি রোধ না করেও যত কম পরিমাণে সম্ভব গ্রীনহাউস গ্যাস বায়ুমন্ডলে নির্গত করা। পৃথিবীতে গ্রীনহাউস গ্যাস (জলীয় বাষ্প, কার্বন-ডাই অক্সাইড, মিথেন ও ওজোন) কমানোর জন্য ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত হয় কিয়োটো প্রোটোকল যা ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কার্যকরি হয়। কিয়োটো প্রটোকলের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে কার্বন ট্রেডিং এর নিয়মনীতি বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। ইউএনএফসিসি যেসব দেশ কিয়োটো প্রটোকল স্বাক্ষর করেছে তাদের বাৎসরিক কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ নির্ধারণ করে দিয়েছে। কোনো সদস্য তার নির্ধারিত অংশের বেশি কার্বন নিঃসরণ করলে তা হবে চুক্তির লঙ্ঘন। তবে কেউ তার বরাদ্দ অংশের চেয়ে কম খরচ করলে অতিরিক্ত অংশ কার্বন ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে বিক্রি করতে পারবে। যেহেতু প্রতিটি দেশের জন্য কার্বন নিঃসরণ একটি সীমার মধ্যে বেঁধে দেয়া হয়েছে, তাই যে দেশ সীমার চেয়ে কম কার্বন নিঃসরণ করবে, সেই অনুপাতে তার নামে কার্বন ক্রেডিট জমা হবে। এই ক্রেডিট সে বিশ্ববাজারে বিক্রি করতে পারবে। আর যারা সীমার চেয়ে বেশি নিঃসরণ করবে, তারা সে ক্রেডিট কিনে নেবে। সোজাভাবে একেই বলা হয় কার্বন ট্রেডিং কার্বন বাণিজ্য ।
মনে করুন, আপনার একটি কোম্পানি আছে, যেটি বছরে ২০০ মেট্রিক টন কার্বন নিঃসরণ করবে। কিন্তু সরকার আপনাকে ১০০ মেট্রিক টনের অনুমোদন দিয়েছেন। এখন আপনি দেশের কোথাও কিছু গাছ লাগালেন যেগুলো বছরে ১০০ মেট্রিক টন কার্বন শোষণ করতে পারবে। এরপর কার্বন ট্রেডারকে আপনি দেখাবেন যে, আপনি সরাসরি ২০০ মেট্রিক টন কার্বন নিঃসরণ করছেন ঠিকই তবে তার থেকে ১০০ মেট্রিক টন আপনার নির্ধারিত গাছ শোষণ করে নিয়েছে। অতএব, আপনি দাবি করতে পারেন যে, আপনি সরকার নির্ধারিত মাত্রা অতিক্রম করেননি। একজন কৃষক জানেন যে, গাছ লাগালে পরিবেশ ভালো থাকে, ভবিষ্যতে অনেক ফুল-ফল পাওয়া যায় আর কাঠ বিক্রি করেও নগদ টাকা মেলে। তারপরও তিনি গাছ লাগাতে ইচ্ছুক নাও হতে পারেন। কারণ তিনি জানেন, অল্প সময়ে এ গাছ থেকে তিনি তেমন কিছুই পাবেন না। এখন একজন লোক এসে কৃষকটিকে বলল যে, গাছ লাগালে সে প্রতিবছর কৃষকটিকে টাকা দেবে। সে ওই গাছ থেকে কিছুই নেবে না; তবে কৃষককে ওই গাছের যতœ নিতে হবে এবং ৩০ বছরের মধ্যে গাছ কাটা যাবে না। কার্বন-ট্রেডিং চালু হলে এটি হবে একটি স্বাভাবিক ঘটনা!

karbon

বাংলাদেশে কার্বন-ট্রেডিংয়ের ধারণা এখনো তাত্ত্বিক পর্যায়েই রয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠান বেসরকারিভাবে কার্বন-ট্রেডিং করার লক্ষ্যে প্রচুর পরিমাণ গাছ লাগানো শুরু করেছে এবং অনেক প্রতিষ্ঠান গাছ লাগানোর ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে কিয়োটো প্রটোকল স্বাক্ষর করেছে। তাই ইচ্ছে করলে কার্বন ট্রেডিংয়ের জন্য আবেদনও করতে পারে। বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে পঞ্চম। যে সব দেশ এর জন্য দায়ী তাদের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে এবং সেই অর্থ পরিবেশ রক্ষায় বিনিয়োগ করতে পারে। একই সঙ্গে দেশে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও পরিবেশ রক্ষায় বিনিয়োগ করতে অনুরোধ করতে পারে।

ইউএনডিপির ২০০৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বজলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ দায়ি নয়। ২০০৪ সালের হিসাব অনুযায়ী গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনে বাংলাদেশের ভূমিকা মাত্র ০.১ শতাংশ এবং মাথাপিছু কার্বন নির্গমনের পরিমাণ মাত্র ০.৩ টন যা কিয়োটো প্রটোকল নির্ধারিত নির্গমন মাত্রার চেয়েও কম। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাথাপিছু কার্বন নির্গমনের হার ১.৫ শতাংশ। ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অনুযায়ী, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বাড়লে বাংলাদেশের ১৫ শতাংশ ভূ-ভাগ সমুদ্রের নিচে তলিয়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তন জনিত আন্তঃসরকার প্যানেলের ২০০৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে ১৯৯৩-২০০৩ সাল পর্যন্ত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতিবছর গড়ে বাড়ছে প্রায় ৩.১ মিলিমিটার। ভবিষ্যতে এই উচ্চতা ৭ মিটার পর্যন্ত বাড়বে। এতে করে বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ ভূ-ভাগ পানির নিচে তলিয়ে যাবে। বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা কমবেশি ১৬ কোটি। জাতিসংঘের হিসাব মতে, ২০৫০ সালে এই সংখ্যা দাঁড়াবে ২২ কোটি ২০ লাখ।

বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে, ২০০৫ সালে ৩৭৪ মেট্রিক টন সমপরিমাণ কার্বনের ট্রেডিং হয়েছে। যার বাজারমূল্য ২০০৫ সালে ছিল ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অনেক দেশ কিয়োটো প্রটোকল স্বাক্ষর না করেও কার্বন-ট্রেডিং পদ্ধতি তাদের দেশে অনুসরণ করছে। এশিয়ার দেশ জাপান তার দেশে ২০১০ সালে কার্বন-ট্রেডিং পদ্ধতি চালু করে পরিবেশ রক্ষায় সাফল্য লাভ করেছে। বাংলাদেশে আছে বিশ্বের অন্যতম বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন, যার কার্বন শোষণের ক্ষমতা অনেক বেশি। এজন্য সরকার সুন্দরবন ছাড়াও আরো ১১টি বনকে কার্বন বাণিজ্যের আওতায় নিয়ে আসার চিন্তাভাবনা করছে।

কার্বন-ট্রেডিং সম্পর্কে সমালোচনাও কম নয়। অনেকেই অভিযোগ করেন, এটি আসলে উপনিবেশবাদের একটি নতুন ধারণা। উপনিবেশবাদী দেশগুলো এর মাধ্যমে অনুন্নত দেশগুলোকে শিল্পায়নে নিরুৎসহিত করে চলেছে। যেহেতু কার্বন-ট্রেডিংকারী প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নতবিশ্বে গড়ে উঠেছে সেহেতু ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ অনুন্নত বিশ্ব থেকে উন্নত বিশ্বের দিকে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে এ চুক্তির ফলে উন্নত দেশগুলো অর্থের বিনিময়ে তাদের কার্বন নিঃসরণের বৈধতা পাচ্ছে। ফলে কার্বন নিঃসরণ তো কোনভাবেই কমছে না বরং ধনীদেশগুলো কার্বন ক্রেডিট কিনে নিয়ে দায়মুক্তি পাচ্ছে এবং অবাধে কার্বন নিঃসরণ করেই যাচ্ছে। অর্থাৎ গ্রীন হাউস গ্যাসের পরিমাণ যেভাবে বাড়ছিল সেভাবেই বাড়ছে। আবার সবচেয়ে বেশি পরিমাণ কার্বন যারা নিঃসরণ করে, এমন অনেক দেশ এখনো কিয়োটো প্রটোকল অনুমোদনই করেনি। কারো কারো মতে, কার্বন-ট্রেডিং সরাসরি নিঃসরণ কমায় না বরং যারা নিঃসরণ করে তাদের নিঃসরণ করতে উৎসাহিত করে। তাই তারা বলছেন কার্বন ট্রেডিং জলবায়ূ পরিবর্তন মোকাবেলায় কোন ভালো উদ্যোগ নয় বরং এটি উন্নত বিশ্বের একটি পরিকল্পিত ফাঁদ। আপাতদৃষ্টিতে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে বলে মনে হলেও, অদূর ভবিষ্যতে এ দেশগুলোই ভবিষ্যতে জলবায়ূ পরিবর্তনের ঝুঁকিতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ছবি সংগৃহীত

happy wheels 2