কোটি টাকার পটল ও কিছু স্বপ্ন পূরণ
সাতক্ষীরা থেকে শাহীন ইসলাম
মাঠে বোরো ধানের সোনালি দোলা আর দৈনিক পটল বিক্রি দুই মিলে যেন কৃষকের খুশির বৈশাখ। এই দৃশ্য উপকূলীয় সাতক্ষীরা জেলা সদরের সবজি গ্রাম মাহমুদপুরে। এই গ্রামের পটল নিয়ে প্রথমে কথা হয় কৃষক মো. নুর ইসলামের (৬০) সাথে। তিনি বলেন, “এক যুগ ধরে পটল চাষ করি। ঔলকপির জমিতে একই সাথে পটল চারা রোপণ করি। কপি উঠে যায় আর পটল তোলা শুরু হয়। এভাবে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত পটল উঠানো যায়।” তিনি বলেন, “এক বিঘা জমিতে পটল চাষে ১৮/২০ হাজার টাকা খরচ হয়। বছরের ৪/৫ মাস একবিঘা জমি থেকে সপ্তাহে ১০/১২ মণ পটল বিক্রি করা যায়। ব্যাপারীরা আমাদের ক্ষেত থেকে পটল কিনে নিয়ে আসে। এ বছর প্রতি কেজি পটল ১৫/১৬ টাকা দরে বিক্রি করেছি”। অন্যদিকে সবজি গ্রামের কৃষক মো. নূরন্নবী বলেন, “পটল চাষ করে আমরা অনেক সখ ও স্বপ্ন পূরণ করি। এ বছর আমি দুই বিঘা জমিতে পটল চাষ করেছি। বিঘাপ্রতি খরচ হয়েছে ২০ হাজার টাকা। বিঘা প্রতি ভালো লাভ হবে। গত বছর আমি ১০ কাঠা জমিতে পটল চাষ করে এক লাখ টাকা লাভ করেছি। এ বছর একতলা পাকা বাড়ি করেছি। বাড়ি করতে পটল চাষের প্রায় ৩ লাখ টাকার লাভের টাকা খরচ করেছি। কিছু টাকা সঞ্চয়ও করতে পারছি।” মাহমুদপুর গ্রামের গৃহিনী জামিলা বেগম বলেন, “আমার স্বামী ১৮ কাঠা জমিতে বর্গভাগে পটল চাষ করেছেন। আমিও পটল ক্ষেতে কাজ করি। ঘাস বাছা, ফুল ছোয়ানো ও পটল তোলার কাজ করি। ক্ষেতের পুরুষ ফুল তুলে প্রতিটি নারী ফুলে ৩ বার ছোঁয়ানো হয়। এতে করে পটল ভালো হয়। একটি পুরুষ ফুল দিয়ে ১০টি নারী ফুলে ছোঁয়ানো যায়। ফুল ছোঁয়ানোর কাজটি আমাদের এলাকায় নারীরাই বেশি করেন। এছাড়া প্রতি সপ্তাহে বিক্রির জন্য পটল তুলি। পটল চাষ করে আমাদের ৫ জনের সংসার ভালোই চলে যাচ্ছে। দৈনিক বাজার খরচ, ঘরের জিনিসপত্র বানানো, পোশাক কেনা ও সখের গহনা তৈরির স্বপ্ন পূরণ পটল চাষ করে হয়।
সাতক্ষীরার সবজি গ্রামের কৃষকেরা বসতভিটা সংলগ্ন ও বিলের উঁচু জমিতে সারাবছর সবজি চাষ করেন। গ্রামের কৃষকেরা মৌসুম ভেদে ঔল কপি, আলু, বেগুন, পটল, বরবটি, কুমড়া, ঢেষড়, লাউ, সজিনা, ঝাল, মূলা, লালশাকসহ বিভিন্ন রকমের সবজি বিলের জমিতে চাষাবাদ করেন। পরিবারেরই প্রত্যেক সদস্য সবজি চাষের সাথে জড়িত। মাহমুদপুর গ্রামের কৃষকেরা নিজ জেলার চাহিদা পূরণের পর বিপুল পরিমাণ সবজি বিক্রি করে স্বচ্ছলতা অর্জন করেছেন। বলা যায়, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এই গ্রামের শত শত বিঘা জমিতে সবজি চাষ হয়। প্রতিদিন সকালে স্থানীয় ব্যাপারীরা পটল চাষীর কাছে বস্তা রেখে আসেন। চাষীরা ক্ষেত থেকে পটল তুলে ওজন করে বাপারীর কাছে দেন। অতঃপর ব্যাপারীরা ভ্যান যোগে ভোমরা বন্দর সড়কের আড়তে নিয়ে আসেন। এভাবে এক একজন ব্যাপারীর পটল চাষীর ক্ষেত থেকে সকাল ১০/১১ টার মধ্যে সমস্ত পটল আড়তে জমা করেন। এরপর সবাই মিলে নির্ধারিত পুকুর ও পাকা হাউসে পটল ধুয়ে বস্তায় ভর্তি করেন। প্রতি বস্তায় ২শ’ কেজি পটল ভর্তি করেন। এভাবে সারি দিয়ে বস্তা ভরা পটল রেখে দেন পানি ঝরানোর জন্যে। বেলা একটার মধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বড় আড়তদার স্থানীয় আড়তদারের কাছ থেকে পাইকারী দরে পটল কিনতে চলে আসেন। গ্রামের ১০৮ জনের ব্যাপরাী দলের সদস্য মো হাফিজুর রহমান এই প্রসঙ্গে বলেন, “আমরা দৈনিক ১২/১৩শ মণ পটল বিক্রি করি। আমাদের এলাকা থেকে প্রতিদিন ৫/৬ লাখ টাকার পটল বিক্রি হয়। এ সব পটল ট্রাকে করে উত্তরবঙ্গ, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল, ঢাকা, খুলনা, বাগেরহাট, নাটোরসহ দেশের ১৭টি জেলায় চলে যায়। আমরা এ বছর পটলের ব্যবসা করে প্রত্যেকে এক লাখ টাকা লাভ করার পরিকল্পনা করেছি। আমাদের এক কোটি ৮ লাখ টাকা পটল বিক্রি করে লাভ করতে হবে। আমরা কেজিপ্রতি একটাকা লাভে পটল বিক্রি করে দেয়।”
স্থানীয়রা কৃষকেরা জানান, প্রতি মৌসুমে মাহমুদপুর গ্রাম থেকে কয়েক কোটি টাকার পটল বিক্রি হয়। পটলের মত কপি, আলু, বেগুণ, পটল, বরবটি, কুমড়া, ঢেড়স, লাউ, সজিনা, ঝাল এবং মূলা ট্রাকে ট্রাকে বিক্রি হয়। কৃষক, ব্যবসায়ী, ক্রেতা ও সরকার সবার উপকার হয়। কিন্তু অনেক সময় কাঁচামালের হঠাৎ দাম কমে যায়। পটল মৌসুমের শেষের দিকে কেজি প্রতি দাম হয় ২/৩ টাকা। এই সংকটকালীন সময়ে সবজি কোল্ডস্টোরেজে রাখতে পারলে ১৫ দিন পর আবারও পূর্বের দামে বিক্রি করা সম্ভব। কাজটি করতে পারলে প্রতিটি সবজির মৌসুমি মন্দা কাটিয়ে ভালোই লাভবান হওয়া যাবে। মাহমুদপুর গ্রামের কৃষকেরা জেলার খাদ্য চাহিদা পূরণ করে দেশের বিভিন্ন জেলার মানুষের চাহিদা পূরণে অবদান রাখে। তাই স্থানীয় কৃষকেরা সাতক্ষীরার সবজি গ্রামে একটি কোল্ডস্টোরেজ বা সবজি সংরক্ষণাগার তৈরির জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন।