জলবায়ুু পরিবর্তন ও আমাদের কৃষি
ঢাকা থেকে এবিএম তৌহিদুল আলম
আবহাওয়া, জলবায়ু ও জলবায়ু পরিবর্তন
কোনো স্থানের স্বল্প সময়ের (এক দিনের) বায়ুুমণ্ডলীয় (বায়ুপ্রবাহ, তাপ, চাপ, বৃষ্টিপাত এবং আর্দ্রতা) অবস্থা হলো আবহাওয়া। জলবায়ু হচ্ছে কোনো নির্দিষ্ট এলাকা বা ভৌগোলিক অঞ্চলের ৩০-৪০ বছরের গড় আবহাওয়া। আর জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে প্রাকৃতিক বা মানুষের কার্যকলাপের কারণে কোনো নির্দিষ্ট এলাকা বা ভৌগোলিক অঞ্চলের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে যে পরিবর্তন সেটাই জলবায়ু পরিবর্তন।
জলবায়ু পরিবর্তন প্রাকৃতিক ও মানুষের কারণে সংঘটিত একটি নৈমিত্তিক ঘটনা। বেশ কয়েকটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া ও মনুষ্যজনিত কারণে জলবায়ু পরিবর্তন হয়। প্রাকৃতিক কারণের মধ্যে রয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন গতিশীল প্রক্রিয়া, পৃথিবী কর্তৃক গৃহীত সৌর বিকিরণের পরিবর্তন, ভূত্বক গঠনের পাততত্ত্ব (ঢ়ষধঃব ঃবপঃড়হরপং), আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত, পৃথিবীর অক্ষরেখার দিক পরিবর্তন কিংবা সূর্যের তুলনায় পৃথিবীর অবস্থান ইত্যাদি। বর্তমান সময়ে মনুষ্যজনিত কারণে গ্রীনহাউজ গ্যাস (ক্লোরোফ্লোরো কার্বন, কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, মিথেন) তৈরির ফলে পৃথিবীর উষ্ণায়নকে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হিসাবে ধরা হয়। মানুষের কর্মকান্ডের ফলে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন গ্যাস এবং ক্লোরোফ্লোরো কার্বন গ্যাস নি:সরণের ফলে পৃথিবীকে বেষ্টনকারী বায়ুমন্ডলের ওজোন স্তরের মধ্যে তাপ আটকে গিয়ে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার দরুণ জলবায়ু পরিবর্তন ঘটে। তবে বর্তমানে জলবায়ুু পরিবর্তন বললে সামাজিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সারা পৃথিবীতে ইদানীং সময়ে মানুষের অপরিণামদর্শী কাজের ফলে ভূমণ্ডলীয় উষ্ণতা বৃদ্ধিকে বোঝানো হয়।
বায়ুমন্ডলীয় তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত বৈশ্বিক পরিস্থিতি
বাতাসে কার্বন ডাই-অক্্রাইড গ্যাসের পরিমাণ বাড়লে যে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রাও বাড়ে ১৮২৪ সালে বিষয়টি প্রথম বর্ণনা করেন জোসেফ ফুরিয়ার। ১৮৯৬ সালে এ সম্পর্কে প্রথম তথ্যানুসন্ধান করেন সুইডিশ রসায়নবিদ আরহেনিয়াস। তিনি দেখান যে, জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো, বনাঞ্চল সাফ করাসহ বিভিন্ন কারণে বাতাসে কার্বন ডাইঅক্্রাইডের পরিমাণ বাড়ছে। এ আবিষ্কারের শতবর্ষপূর্তির ঠিক পরপরই ১৯৯৭ সালে পৃথিবীজুড়ে বায়ুমন্ডলীয় তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ে বৈশ্বিক আলোচনা শুরু হয়। বর্তমান পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের গড় তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। বায়ুমন্ডলীয় তাপমাত্রা ওঠানামার ঘটনা প্রাকৃতিক হলেও বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, বর্তমান সময়ে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে দ্রুত হারে বায়ুমন্ডলীয় তাপমাত্রা বাড়ছে। ১৭৫০ সালে শিল্পবিপ্লব শুরু হওয়ার পর থেকে বেড়েছে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার। এরপর থেকেই অধিক হারে বায়ুমন্ডলীয় কার্বন ডাইঅক্সাইড’র পরিমাণও বেড়ে চলেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন বিগত ৫ হাজার বছরে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়েছে ৪ থেকে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অপরদিকে বিগত ১০০ বছরেই তাপমাত্রা বেড়েছে ০.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস যা গড়ে ১২ হাজার বছর আগের বরফযুগের পরবর্তী উষ্ণতা বৃদ্ধির ১০ গুণ। সুইজারল্যান্ডেে জেনেভায় অবস্থিত বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডড়ৎষফ গবঃবড়ৎড়ষড়মরপধষ ঙৎমধহরুধঃরড়হ ) জানিয়েছে, বিস্তৃত শিল্পায়নের আগের সময় হতে বর্তমানে পৃথিবী গড়ে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণ হয়েছে।
একদল বিজ্ঞানী বলছেন ১৮৮০ সাল থেকে ১৯৮৬ সালের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা ০.৬ ডিগি সেলসিয়াস বেড়েছে। আর ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর ঊষ্ণতা ২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২০৫০ সাল নাগাদ ৩.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে। অন্যদিকে জাতিসংঘের ইন্টার-গভর্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ বা আইপিসিসি প্রকাশিত ২০১৪ সালের সর্বশেষ প্রতিবেদন জানাচ্ছে, গত ১০০ বছরে সারা বিশ্বে গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ০.৭৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই অবস্থা চলতে থাকলে আগামী শতকে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বাড়বে ৬ থেকে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই বৈজ্ঞানিক রিপোর্টে দেখানো হয়েছে উন্নত দেশগুলো সচেতন হলে আগামী শতকে তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বাড়বে না। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির অধিকাংশই হয়েছে পরিবেশের ওপর মানুষের মাত্রাহীন অত্যাচারের ফলে। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘সাইন্স’ ৯২৮টি আলাদা গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করে ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেখায় যে, ৭৫ শতাংশ গবেষণায় সরাসরি পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য মানুষের আচরণই দায়ী। আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে পৃথিবীর স্বাভাবিক তাপমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ৬১ দশমিক ৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট, যা ১৯৬১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর তাপমাত্রার গড়। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডড়ৎষফ গবঃবড়ৎড়ষড়মরপধষ ঙৎমধহরুধঃরড়হ ) তথ্যানুসারে ১৮৮০ সালে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ছিল ১৩.৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস যা ২০০০ সালে বেড়ে হয়েছে ১৪.৫১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর ১৯৯৭ সালের পৃথিবীর তাপমাত্রা ছিল গত শতাব্দীর গড় তাপমাত্রার চেয়ে ১ ডিগ্রি বেশি। অন্যদিকে নাসার জলবায়ুবিদরা বলেছেন, শতাব্দীর মধ্যে উষ্ণতম বছর ছিল ২০০৫।
বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্্রাইডের গাঢ়ত্ব ১৯৫৮ সাল থেকে নথিভুক্ত করা শুরু হয়েছে। গ্রীনল্যান্ড ও দক্ষিণ মেরুর বরফের মধ্যে আবদ্ধ বুদবুদ বাতাসের রাসায়নিক পরীক্ষার মাধ্যমে শিল্পবিপ্লবের আগে বাতাসে কার্বন ডাইঅক্্রাইডের পরিমাণ নিরূপণ করা হয়েছে। একটি সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে, ১০০০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত গড় কার্বন ডাইঅক্্রাইডের গাঢ়ত্ব ছিল মাত্র ২৮০ পিপিএমভি (চধৎঃ ঢ়বৎ গরষষরড়হ নু ঠড়ষঁসব) । ১৯৫৮ সালে বাতাসে কার্বন ডাইঅক্্রাইডের গাঢ়ত্ব ছিল ৩১৫ পিপিএমভি। তখন প্রতিবছর বৃদ্ধির হার ছিল ০.৬ পিপিএমভি। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে গড় গাঢ়ত্ব ১৯৯০ সালে ছিল ৩৫৩ পিপিএমভি এবং প্রতিবছর তা গড় ১.৮ পিপিএমভি বাড়ছে।
২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য বর্তমানে সবচেয়ে বেশি দায়ী দেশ হলো চীন। কলকারখানা, শিল্পের বিকাশ ও জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে দেশটি সবচেয়ে বেশি কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ করছে যার পরিমাণ বছরে ১১ হাজার ২৫৬ মেগাটন। এরপরেই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত ও রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্র ৫ হাজার ২৭৫ মেগাটন, ইইউ ৩ হাজার ৪৫৭ মেগাটন ও ভারত ২ হাজার ৬২২ মেগাটন কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ করে। তবে মাথাপিছু হারে যুক্তরাষ্ট্র আর ইইউ বেশি কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণের জন্য দায়ী। বিজ্ঞানীরা এও বলছেন, এখনই যদি গ্রীনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে দেওয়া হয় তবুও পরিবেশে সেই প্রভাব পরিলক্ষিত হতে ও তাপমাত্রা কমতে শতবছর লেগে যাবে। আর বায়ুমণ্ডল থেকে সেই অতিরিক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস সরে যেতে লেগে যাবে কয়েক দশক।
তাপমাত্রা বাড়ার ফলে হিমালয় পর্বতের হিমবাহগুলো গলে যাচ্ছে, কিন্তু পরে আর তেমন বরফ জমছে না। সর্বশেষ পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী হিমালয় পর্বতের হিমবাহগুলো বছরে ২৩ মিটার করে কমে যাচ্ছে। ইউরোপের আল্পস পর্বতমালায় ও একই উপর্সগ দেখা দিয়েছে। একই সময়ে উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরুতে বেশিমাত্রায় বরফ গলছে। আর এই বরফ গলে বাড়তি পানি সমুদ্রে মিশে সমুদ্রের পানি বাড়াচ্ছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে শুধু যে বেশি বেশি করে বরফ গলে যাচ্ছে ও সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ছে তাই নয়, পৃথিবীর বহু শুষ্ক অঞ্চল উষ্ণতর হচ্ছে আবার বিষুবীয় অঞ্চলে বৃষ্টিপাত বেড়ে গিয়ে আর্দ্র এলাকাগুলো আরো আর্দ্রতর হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও আমাদের কৃৃষি
বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান, আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো, প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর র্নির্ভরশীলতার কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঝুকিপূণ দের্শ। গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্্র’র ২০১৯ প্রতিবেদন অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ৭ম বিপদাপন্ন দেশ হলো বাংলাদেশ। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে। এতে পাল্টে যাচ্ছে আবহাওয়ার ধরন এবং ঋতুবৈচিত্র্য। বলা হয় বাংলাদেশের প্রায় পনের কোটি মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি শিকার হবে।
কৃষিখাত বৈরী জলবায়ুর কারণে সবচেয়ে বেশী সংবেদনশীল। পরিবর্তিত জলবায়ুতে কৃষি উৎপাদন হ্রাসের ফলে খাদ্যনিরাপত্তা, মানুষের সার্বিক জীবনব্যবস্থা, সম্পদ ও জীবন-জীবিকার ওপর আঘাত ও ক্ষতিকর প্রভাব ইতোমধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই পরিবর্তনের কারণে বন্যা, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, খরার মত ঘটনা বেড়েছে। বাংলাদেশের যেখানে প্রায় শতকরা ১৪.২৩ ভাগ জিডিপি আসে কৃষি থেকে এবং মোট শ্রমশক্তির ৪০.৬ % কৃষিতে নিয়োজিত সেখানে জলবায়ুর বৈরী আচরণ আমাদের অর্থনীতিকে ও হুমকির দ্বারপ্রান্তে উপনীত করেছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কৃষিতথ্য সার্ভিসের তথ্যানুসারে বিগত ২৫ বছরের আবহাওয়ার উপাত্ত থেকে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের গড় উষ্ণতা তেমন বাড়েনি। তবে আশঙ্কা করা হয় যে, ২০৩০ সাল নাগাদ গড় তাপমাত্রা ১.০ ডিগ্রি, ২০৫০ সালে ১.৪ ডিগ্রি এবং ২১০০ সালে ২.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে। সাম্প্রতিককালে তাপমাত্রা না বাড়লেও উষ্ণ ও শৈত্যপ্রবাহের মাত্রা বেড়েছে। বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে শীতকালের ব্যাপ্তি ও শীতের তীব্রতা দুইই কমে আসছে। অন্যদিকে ২০১৪ সালে প্রকাশিত আইপিসিসি’র ৫ম সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের গড় বার্ষিক তাপমাত্রা গত ১৪ বছরে (১৯৮৫-১৯৯৮) মে মাসে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং নভেম্বর মাসে ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে মৌসুমি বায়ু প্রভাবিত এলাকা বাংলাদেশে বর্ষাকাল দীর্ঘায়িত হচ্ছে। তাই বদলে যাচ্ছে বৃষ্টিপাতের ধরন। অল্প সময়ে অতিবৃষ্টি তারপর দীর্ঘ সময় ধরে অনাবৃষ্টি প্রায়শই আমাদের কৃষি অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। তাই বাড়ছে বন্যা ও খরার প্রকোপ। এটা শুধু কৃষি অর্থনীতিতেই নয়, আঘাত হানছে বাস্তুতন্ত্রেও। বৈরী জলবায়ুর কারণে কৃষিখাতের বর্তমান বিরূপ পরিবর্তন ও ভবিষ্যতের সম্ভাব্য হুমকিগুলো হলো:
কমে যাবে শস্য-ফসলের উৎপাদন
খাদ্যশস্য উৎপাদনের প্রধানতম খাত কৃষি যা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তন ফসলের ফলনে আনছে মারাত্বক ক্ষতিকর প্রভাব। বায়ুমন্ডলীয় কার্বন ডাইঅক্সাইড বৃদ্ধির ফলে সালোক সংশ্লেœষণ কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও আবহাওয়া এবং বর্ধিত তাপমাত্রার কারণে দানাজাতীয় ফসলে প্রোটিনের পরিমাণ কমে। গবেষণায় দেখা গেছে, অধিক কার্বন ডাইঅক্সাইডের ফলে উদ্ভিদের নাইট্রোজেন, আয়রণ ও জিংক গ্রহনের ক্ষমতা হ্রাস পায় যা ফসলের গুণাগুনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। আমাদের মতো পুষ্টিঘাটতির দেশে দানা ফসলের গুণাগুণ কমে যাওয়া পুষ্টি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় হুমকি। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে উফশী ধানের ফলন কমে যাবে এবং গম ফসলে রোগের সংক্রমণ বাড়বে। বাংলাদেশে বর্তমানের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে গম চাষ আর সম্ভব হবে না। ধান গাছের কচি থেকে ফুল ফোটার সময় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার চেয়ে বেশি হলে এবং অতি নিম্ন তাপে (২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে) শিষে ধানের সংখ্যা কমে ও চিটা বেশি হবে। ফুল ফোটা বা পরাগায়নের সময়ও যদি তাপমাত্রা বেশি থাকে তাহলে চিটার সংখ্যা বেশি হবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও কার্বন ডাই অক্্র্রাইডের পরিমাণ বাড়ার কারণে ধান গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, ধান গাছ হলুদ বর্ণ ধারণ করে, ধানের চারা দুর্বল হয় এবং ফসলের জীবনকাল বাড়ে।
কৃষিতথ্য সার্ভিসের পর্যবেক্ষণ হলো সাম্প্রতিককালে তাপমাত্রা না বাড়লেও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে উষ্ণ ও শৈত্যপ্রবাহের মাত্রা বেড়েছে। ক্রমান্বয়ে শীতকালের ব্যাপ্তি ও শীতের তীব্রতা দুইই কমে আসছে ফলে বেশির ভাগ রবি ফসলেরই স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়ে ফলনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ ছাড়া শীত মৌসুমে উষ্ণ প্রবাহ দেখা দিলে বেশি সংবেদনশীল ফসল যেমন গমের ফলন খুব কমে যায় এবং গম উৎপাদন অলাভজনক হয়। হঠাৎ তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হলে সরিষা, মসুর, ছোলা ইত্যাদি ফসলের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে এবং এসব ফসলের পরাগায়ন ব্যাহত হয়ে ফলন খুব কমে যায়। শৈত্যপ্রবাহের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কুয়াশাচ্ছন্ন থাকলে অনেক ফসল বিশেষ করে গমের পরাগায়ন (পলিনেশন) ও গর্ভধারণ (ফার্টিলাইজেশন) না হওয়ায় আংশিক বা সম্পূর্ণ ফসল চিটা হয়ে যায় এবং পোকামাকড়ের উপদ্রব বেড়ে যায়। উষ্ণতা বাড়ার ফলে গাছের প্রস্বেদন বাড়ায় অধিক পরিমানে পানি গাছ থেকে বের হয়ে যায় বলে সেচের প্রয়োজন বেড়ে যায়। শৈত্যপ্রবাহে আমের মুকুল নষ্ট হয় ও নারিকেলের ফলধারণ ব্যাহত হয়।
বিজ্ঞানীরা আশংকা করছেন, ২১০০ সাল নাগাদ ফসলের ফলন ৩০% হারে কমবে। ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ধানের উৎপাদন ৮.৮% এবং গমের উৎপাদন ৩২% কমবে। ফলে খাদ্য নিরাপত্তায় দেখা দেবে অনিশ্চয়তা। সবকিছু অক্ষুন্ন রেখে যদি দেশের তাপমাত্রা বর্তমানের চেয়ে ১ ডিগ্রিও বৃদ্ধি পায়, তবে ধানের মোট উৎপাদনের প্রায় ১৭ শতাংশ এবং গমের উৎপাদন ৬১ শতাংশ কমে যাবে। অন্যদিকে আইপিসিসি বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ৮ শতাংশ ধান ও ৩২ শতাংশ গমের উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন।
শস্য-ফসলের রোগব্যাধি ও আগাছার প্রকোপ বৃদ্ধি
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সৃষ্ট অধিক তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা ফসলের রোগব্যাধি এবং আগাছার বংশবিস্তারে সহায়ক। অধিক আর্দ্রতার সাথে স্বাভাবিকের চেয়ে খানিকটা বেশি তাপমাত্রা ছত্রাক ও ব্যকটেরিয়ার দ্রুত বংশবৃদ্ধি ও সংক্রমণ বাড়িয়ে দেয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ইতোমধ্যে পোকামাকড় এবং বিভিন্ন উদ্ভিদে রোগের আক্রমণ বেড়ে গেছে। দানাশস্যসহ বিভিন্ন ফসলে মিলিবাগ, এফিড, ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকজনিত রোগের আক্রমণ দিনদিন বাড়ছে। এছাড়া অতিরিক্ত তাপ এবং আর্দ্রতা গাছের পোকামাকড় ও বিভিন্ন রোগের বাহক পোকার সংখ্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে। বোরো মৌসুমে যদি রাতে ঠান্ডা ও কুয়াশা পড়ে ও ধানের পাতায় পানি জমে থাকে এবং দিনে গরম পড়ে অর্থাৎ তাপমাত্রা বেড়ে যায় তবে ব্লাইট রোগের আক্রমণ বেড়ে যায়। অধিক আর্র্দ্রতা ও তাপমাত্রার কারণে শীথব্লাইট রোগের প্রকোপ বাড়ে। গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের দেশে সত্তরের দশক থেকে এখন পর্যন্ত ফসলের রোগের সংখ্যা পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে আর এতে আবহাওয়ার প্রভাবকেই বিজ্ঞানীরা দায়ী করেছেন।
কৃষি জমির লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া
ফসলি জমিতে লোনা পানির অনুপ্রবেশ বাংলাদেশের কৃষির মারাত্মক একটি সমস্যা। বাংলাদেশের মোট উপকূলীয় এলাকা প্রায় ২৫ লাখ হেক্টর। ১৯৭৩ সালে প্রায় ১৫ লাখ হেক্টর জমি মৃদু লবণাক্ততায় আক্রান্ত ছিল যা ১৯৯৭ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ লাখ হেক্টরে। কম বৃষ্টিপাতের কারণে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত জমির পরিমাণ বাড়ছে যা ভবিষ্যতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং পরিমিত বৃষ্টিপাতের অভাবে ২০৫০ সালে মোট কৃষিজমির ১৬ শতাংশ এবং ২১০০ সালে ১৮ শতাংশ পর্যন্ত হবে বলে আশংকা রয়েছে। উজান থেকে পানিপ্রবাহ বাধা ও কম বৃষ্টিপাতের কারণে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত জমির পরিমাণ বাড়ছে। ২০০০ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা রিপোর্টে কক্্রবাজার উপকূলে বছরে ৭.৮ মিমি. হারে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। গত চার দশকে ভোলা দ্বীপের প্রায় তিন হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা সমুদ্রের পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্ট পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২১০০ সাল নাগাদ সাগর পৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার উঁচু হতে পারে যার ফলে বাংলাদেশের মোট আয়তনের ১৮.৩ অংশ নিমজ্জিত হতে পারে।
বাংলাদেশের উপকূলীয় প্রায় ১৩ শতাংশ এলাকা বিশেষ করে বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের মাটিতে লবণাক্ততার প্রভাব দেখা যায়। বর্ষা মৌসুমে উপকূলীয় বন্যার ফলে সরাসরি লবণাক্ত পানি দিয়ে কৃষিজমি ডুবে যাওয়া এবং শুষ্ক মৌসুমে মাটির নিচে থাকা লবণাক্ত পানির ওপরের দিকে বা পাশের দিকে প্রবাহিত হওয়ার কারণে মাটিতে লবণের পরিমাণ বেড়ে যায় যা মাটির উর্বরতা নষ্ট করে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে বাংলাদেশের বিরাট একটা অংশের কৃষিজমি লবণাক্ততায় আক্রান্ত হবে যা উপকূলীয় এলাকায় ফসল চাষের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশে এরই মধ্যে লবণাক্ততা প্রবণ এলাকায় ধানের ফলন কমে গেছে। বিশেষত পটুয়াখালী জেলার ধানের গড় ফলন জাতীয় উৎপাদন গড়ের চেয়ে ৪০ শতাংশ এবং নওগাঁর তুলনায় ৫০ শতাংশ কম। সহনীয় জলবায়ু পরিবর্তন পরিবেশে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশের ফলে বছরে প্রায় ২০ লাখ টন ফসল নষ্ট হচ্ছে। পর্যালোচনা থেকে দেখা যায়, স্থিতাবস্থা পরিস্থিতিতে ফলন হ্রাসের ফলে বার্ষিক ধানের উৎপাদন ২০৫০ সালে ১ দশমিক ৬০ শতাংশ এবং ২১০০ সালে আরো ৫ দশমিক ১ শতাংশ হ্রাস পাবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট পুনঃপুন বন্যায় কৃষিখাত আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বঙ্গোপসাগরের লোনা পানিতে এর মধ্যে ৮ লক্ষ ৩০ হাজার হেক্টর আবাদি জমি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বেড়েছে। গ্রীষ্মকালে সমুদ্রের লোনাপানি দেশের অভ্যন্তরে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত নদীতে প্রবেশ করে। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর প্রলয়ঙ্করী সাইক্লোন সিডর হানার মাত্র দুই বছরের মধ্যে শক্তিশালী সাইক্লোন নার্গিস ও আইলা এবং ২০১৩ সালের মে মাসে মহাসেন আঘাত হেনে উপকূলীয় কৃষিকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। অতি সম্প্রতি ২০ মে ২০২০ তারিখে ’আম্পান” ঘুর্ণিঝড়টি উপকূলে আঘাত হেনে জানমাল ও সুপেয় পানির সঙ্কটকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
নদী ভাঙন, ভূমিক্ষয় ও বন্যার প্রকোপ বাড়া
বাংলাদেশ পানিসম্পদে সমৃদ্ধ হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অতিবৃষ্টি, বন্যা ও জলাবদ্ধতার প্রকোপ ক্রমাগত বাড়ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ১.৫ মিলিয়ন হেক্টর জমি প্রতি বছর বন্যা কবলিত হয়। কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষিতথ্য সার্ভিসের হিসাব মতে আকস্মিক বন্যার শিকার হয় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রায় ৪ হাজার বর্গকিলোমিটার ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ১ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা। সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনা, নীলফামারী ইত্যাদি জেলা আকস্মিক বন্যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় প্রতি বছর হাজার হাজার একর জমির পরিপক্ব বোরো ধান সংগ্রহের আগেই আকস্মিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মৌসুমি বন্যা উপকূলীয় এলাকায় তেমন সমস্যার সৃষ্টি করে না। তবে জোয়ারজনিত বন্যা উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে। এর ফলে জমিতে লবণাক্ত পানির জলাদ্ধতার সৃষ্টি হয় যা ফসল চাষের জন্য জমিকে অনুপযোগী করে তোলে।
বাংলাদেশের গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২৩০০ মি.মি. এবং অঞ্চল ভেদে তা ১২০০ মিমি (দক্ষিণ-পশ্চিম) থেকে ৫০০০ মিমি (উত্তর-পূর্বাঞ্চল) পর্যন্ত হয়ে থাকে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়েছে এবং ২০৩০ সালে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১০-১৫ শতাংশ এবং ২০৭৫ সালে প্রায় ২৭ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে বন্যার সংখ্যা ও তীব্রতা দুটোই বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাভাবিক বন্যায় দেশের মোট আয়তনের প্রায় ২০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়। দেশে ভয়াবহ বন্যার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে বিগত ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০২, ২০০৩, ২০০৪ ও ২০০৭ সালে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের জরিপে এ পর্যন্ত ১,২০০ কিমি. নদী তীর ভেঙে গেছে এবং আরও ৫০০ কি.মি. ভাঙনের সম্মুখীন। স্যাটেলাইট চিত্র থেকে দেখা যায়, ১৯৮২ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ১,০৬,৩০০ হেক্টর নদী তীরের ভাঙনের বিপরীতে মাত্র ১৯,০০ হেক্টর নতুনভূমি গঠন হয়েছে। জলবায়ুর পরিবর্তন অব্যাহত থাকলে ভাঙা গড়ার এ ভারসাম্য আরও প্রকট হবে।
খরা বেড়ে যাওয়া
বর্তমানে একদিকে পানি চক্রের স্বাভাবিক ছন্দে যেমন বিঘœ ঘটেছে অপরদিকে শুকনো মৌসুমে বৃষ্টি কমছে। বর্তমানে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ১১ জেলার ৭,৭৭০ বর্গ কি.মি এলাকা জুড়ে অবস্থিত বরেন্দ্র অঞ্চলে ঘন ঘন খরার প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। খরার তীব্রতা অনুসারে অতি তীব্র, তীব্র, মাঝারি ও সামান্য এই চারভাগের মধ্যে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও দিনাজপুর জেলার ৩,৪২,৯৯০ হেক্টর জমি তীব্র খরার অন্তর্ভূক্ত। খরার কারণে এইসব এলাকায় ফসলের ৩০-৭০% ক্ষতি হয়। বরেন্দ্র অঞ্চলে অক্টোবর মাসের খরা রোপা আমনে খোড় অবস্থায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে যা থেকে ৭০-৯০ ভাগ ফলন কমিয়ে দেয়। খরার সময় বরেন্দ্র অঞ্চল তপ্ত হয়ে ওঠে, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামে, মাটিতে আর্র্দ্রতায় ঘাটতি হয়, দেখা দেয় গবাদি প্রাণির খাদ্যসংকট।
বাংলাদেশে প্রতি বছর ৩০ থেকে ৪০ লাখ হেক্টর জমি বিভিন্ন মাত্রার খরার কবলে পড়ে। গাছের বৃদ্ধি পর্যায়ে বৃষ্টিপাতের অভাবে মাটিতে পানিশূন্যতা সৃষ্টি হয় যা গাছের ক্ষতি করে। কম বৃষ্টিপাত এবং অধিক পরিমানে মাটি থেকে পানি বাষ্পীভূত হওয়ার ফলে কৃষিজমিতে খরার প্রভাব দেখা যায়। এপ্রিল থেকে মধ্য নভেম্বরের মধ্যে পর পর ১৫ দিন বৃষ্টি না হলেই খরা দেখা দেয়। দেশে বিভিন্ন মাত্রায় খরায় আক্রান্ত চাষযোগ্য শতকরা ৬০ ভাগ জমিতে আমন ধান চাষ করা হয়। এ ছাড়াও খরা আউশ, বোরো ধান, পাট, ডাল, তেল ফসল, আলু, শীতকালীন সবজি এবং আখ চাষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। মার্চ-এপ্রিলের খরা চাষের জন্য জমি প্রস্তুতিতে অসুবিধার সৃষ্টি করে ফলে বোনা আমন, আউশ এবং পাট চাষ যথাসময়ে চাষাবাদ করা যায় না। মে-জুন মাসের খরা মাঠে থাকা বোনা আমন, আউশ এবং পাট ফসলের ক্ষতি করে। আগস্ট মাসের অপরিমিত বৃষ্টি রোপা আমন চাষকে বাধাগ্রস্ত করে। সেপ্টেম্বর- অক্টোবর মাসের কম বৃষ্টিপাত বোনা ও রোপা আমন ধানের উৎপাদন কমিয়ে দেয় এবং ডাল ও আলু ফসলের চাষ দেরি করিয়ে দেয়। কাঁঠাল, লিচু, কলা ইত্যাদি ফলের গাছ অতিরিক্ত খরায় মারা যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শুষ্ক মৌসুমে নদী-নালার নাব্য হ্রাস এবং গাছের প্রস্বেদনের হার বেড়ে যাওয়ায় সুপেয় পানির অভাব দেখা দেয়। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সূত্র মতে রাজশাহীর উচ্চ বরেন্দ্র এলাকায় ১৯৯১ সালে পানির স্তর ছিল ৪৮ ফুট গভীরে, ২০০০ সালে তা নেমে ৬২ ফুট এবং ২০০৭ সালে তা আরও নেমে ৯৩.৩৪ ফুটে গভীরে চলে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূ-গর্ভের পানির স্তর সাধারণত গড়ে ১৩০ ফুটের মধ্যে অবস্থান করছে। রবি মৌসুমে বরেন্দ্র এলাকায় মাটির ১ মিটার পর্যন্ত গভীরে পানি জমা থাকে মাত্র ১৫০-১৯৭ মি.মি.। সম্প্রতি রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার বাঁধাইড় ইউনিয়নকে ওয়াটার স্টেজ (পানি সংকটপূর্ণ) হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। একই ভাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়নও পানি সংকটপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে।
কমে যাবে আবাদি জমি
একটি গবেষণা প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে যে, ষাটের দশক থেকে এখন পর্যন্ত সাইবেরিয়া অঞ্চলে প্রায় তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে যা সেখানকার বরফ গলে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ বাড়িয়েছে। কিন্তু এই বরফগলা অব্যবহত থাকলে তা সমুদ্রের পানির উচ্চতা এক মিটার বাড়াবে। আর এর ফলে বাংলাদেশসহ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ধান উৎপাদন ও রপ্তানিকারক দেশগুলোর নিচু জমিগুলো পানির নিচে তলিয়ে যাবে। ফলশ্রুতিতে ধানের জমি হ্রাস পাওয়ায় আমাদের দেশসহ সারাবিশ্বের উন্নত-অনুন্নত অনেক দেশে খাদ্যের সংকট দেখা দিতে পারে। জাতিসংঘের ইন্টার-গভর্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ বা আইপিসিসির মতে, আগামী ৫০ বছরের মধ্যে সমুদ্রের পানির উচ্চতা এক মিটার বেড়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। সমদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বাড়লে বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ আবাদি জমি লবণাক্ত পানিতে তলিয়ে যাবে। এতে ১৩ শতাংশ বা প্রায় ২ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবেন। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের আবাদি জমি পানির নিচে ডুবে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তা। অসংখ্য মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবেন।
মাটির উর্বরতা হ্রাস, ভূমিক্ষয় ও ভূমির ধ্বস হওয়া
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অল্প সময়ে অত্যাধিক বৃষ্টিপাতের কারণে মাটির উপরিস্তরের ভূমি ক্ষয় বাড়বে, বাড়বে ভূমি ধ্বস। ফলে মাটির উপরিস্তরের পুষ্টিমানের অবক্ষয় হয়ে মাটির উর্বরতা হ্রাস পাবে। সেই সাথে অধিক তাপমাত্রা মাটিস্থ জৈব পদার্থের পরিমাণও কমিয়ে দেবে। এছাড়া তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে মাটিতে খনিজ উপাদানের পরিমাণও বাড়তে থাকবে যা ফসলের জন্য কমবেশি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশের জমিতে যেখানে জৈব পদার্থের পরিমাণ এমনিতেই ২ শতাংশের কম সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তা আরো কমে যাবে। কেননা অধিক আর্দ্রতা ও তাপমাত্রায় মাটির জৈব পদার্থের বিয়োজন বেশি হবে তাই মাটির জৈব পদাথে পরিমাণও কমবে।
ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মির প্রভাব বেড়ে যাওয়া
তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীকে বেষ্টনকারী ওজোন স্তরের যে ক্ষয় হয় তার ফলে সূর্যের অতি বেগুনী রশ্মির রেডিয়েশন পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে যা উদ্ভিদের শরীরতত্ত্বে প্রভাব এনে কৌলিতাত্ত্বিক ভিন্নতা সম্পন্ন পরিবর্তিত (মিউট্যান্ট) জাত সৃষ্টি করতে পারে। আবার এই মিউট্যান্টে পোকামাকড় বা রোগজীবাণুর সংক্রমণ প্রবণতা বাড়তে পারে।
বেড়ে যাবে ফসলের উৎপাদন খরচ
জলবায়ু পরিবর্তন বিভিন্নভাবে সেচের পানি ব্যবহারের ওপর প্রভাব ফেলছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও সূর্যালোকিত আবহাওয়ায় ফসলের প্রস্বেদনের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে গাছের পানি ব্যবহার বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে কৃষিকাজে সেচের জন্য ভ-ূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত উত্তোলনে মাটির ভেতরের পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বরেন্দ্র এলাকায় ভূগর্ভস্থ ও ভূ উপরিস্থ পানির পরিমাণ কমে গেছে। ফলে আরো গভীর করে নলকূপ স্থাপন করতে হচ্ছে। ২০১২-২০১৩ সালে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ৮টি জেলায় বোরো ধান চাষে হেক্টরপ্রতি গড়ে ১৩.৯০ মিলিয়ন লিটার ভূগর্ভস্থ পানি পানি উত্তোলন করার প্রয়োজন হয়। উচ্চ বরেন্দ্র অঞ্চলের অবস্থা এমনই যে, নলকূপগুলো থেকেও এখানে দৈনন্দিন খাবারের পানি পাওয়া যাচ্ছে না। কুড়ি বছর আগে অগভীর নলকূপ থেকেও যেখানে সেচ-পানি পানি পাওয়া যেত বর্তমানে অনেক গভীর নলকূপও আর মাটির নিচ থেকে পানি টেনে আনতে পারছে না। আবার কোনো কোনো বছর বৃষ্টিপাত দেরিতে শুরু হওয়ায় বা আগাম শেষ হওয়ায় বর্তমানে বৃষ্টিনির্ভর রোপা আমন ধানের দানা পুষ্ট হওয়ার আগেই মাটিতে রসের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। সম্পূরক সেচ দেওয়া না হলে এই ধানের ফলনও কমে যাচ্ছে। ফলে বাড়ছে সেচ খরচ।
হুমকির মুখে মৎস্য খাত
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হুমকির মুখে মৎস্যখাত। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির সহায়তায় ’সাসটেইনেবল এনভারনমেন্ট ম্যানেজম্যান্ট কর্মসূচি’ কর্তৃক ২০০২-২০০৩ সালে প্রকাশিত তথ্যমতে, বিগত ২০ কিংবা ৩০ বছর আগে বাংলাদেশে যে ধরনের মাছ পাওয়া যেত বর্তমানে তার বহু প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে বা বিলুপ্তির মুখোমুখি। পানির তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এর বেশি হলে চিংড়ি মাছের মৃত্যুহার বেড়ে যায়। চিংড়ি ছাড়া এই তাপমাত্রায় আরও অনেক মাছের রোগব্যাধি বাড়ে। তাপমাত্রা বাড়ার ফলে বদ্ধ জলাশয়ে মাছের কৃত্রিম প্রজননে সমস্যা হচ্ছে এবং তাই সময়মতো পুকুরে ছাড়ার জন্য পোনা মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া এই উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছের প্রজাতি মাইগ্রেট করতে পারে কিংবা মাছের প্রজনন ও মাইগ্রেশনের সময় পরিবর্তিত হতে পারে, কমতে পারে প্রজাতি বৈচিত্র্য। আইপিসিসি’র এর ৫ম প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনে দক্ষিণ এশিয়া বিশেষ করে বাংলাদেশের মিঠা পানির প্রবাহে ব্যাঘাত ঘটবে।
প্রাণবৈচিত্রের উপর বিরূপ প্রভাব
জলবায়ু পরিবর্তনে পৃথিবীর অনেক প্রাণবৈচিত্র্য ইতোমধ্যেই বিলুপ্ত হয়েছে। বিশ্বের তাপমাত্রা ১.৫ হতে ২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে ২০-৩০ শতাংশ গাছপালা ও পশুপাখির জীবনের উপর ভয়াবহ ঝুঁকির সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৩০ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। বিপন্ন প্রাণীসমূহের মধ্যে রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিতাবাঘ, হাতি, অজগর, কুমির, ঘড়িয়াল ইত্যাদি। বিগত শতাব্দীতেই বাংলাদেশ থেকে ১৯ প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। যার মধ্যে অন্যতম হলো গন্ডার, বুনো মোষ, কালো হাঁস, নীলগাই, রাজশকুন ইত্যাদি। তবে কারো কারো মতে এই জনপদ থেকে ২৭ ধরনের বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব বিপন্ন হয়েছে ও ৩৯ টি প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়েছে।
মোকাবিলায় প্রয়োজন সদিচ্ছা আর সম্মিলিত উদ্যোগ
জলবায়ুর বৈরী প্রভাবে বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তায় চ্যালেঞ্জ ক্রমশ বাড়বে সন্দেহ নেই। আগে দেশের কৃষকদের চাষাবাদের সময় সূচী সম্পর্কে একটা পূর্ব প্রস্তুতি ছিল; কোন সময়ে কী ফসল চাষ করবেন, তার প্রস্তুতি নিতে পারতেন। এখন সবই অনিশ্চয়তাময়। পরিবর্তিত জলবায়ুর সাথে খাপ খাওয়ানোর মত (লবণাক্ততা, বন্যা, খরা, জলাবদ্ধতা ও খরাসহিষ্ণু) ফসলের আরোও জাত উদ্ভাবন ও চাষাবাদ বাড়াতে অধিকতর গবেষণা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। দেশের প্রতিটি উপজেলার জলবায়ুর ঝুঁকি মানচিত্র তৈরি করে কৃষি, খাদ্য ও অবকাঠামোসহ সবগুলো বিষয় নিয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন তা বাস্তবায়নের জন্য এগুতে হবে। পাশাপাশি নতুন ফসলবিন্যাস উদ্ভাবনও কৃষি অভিযোজন কৌশলের ওপর ব্যাপক গবেষণা প্রয়োজন। আবহাওয়ার মতো কৃষি পূর্বাভাস ব্যবস্থা গড়ে তুলে বৈরী জলবায়ুর ঝুঁকি থেকে কৃষকদের ফসল সুরক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। একাজে সরকারের নীতি নির্ধারক, গবেষক-বিজ্ঞানী, কৃষকও কৃষিজীবী জনগোষ্ঠিসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সচেতনতা ও সক্রিয় অংশগ্রহনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। একইসাথে নদীগুলোর নাব্যতা ফিরিয়ে এনে উপকূলীয় অঞ্চলে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলার কার্যকরী ব্যবস্থাও নিতে হবে। পরিবেশের জন্য হুমকি এমন কর্মকান্ড পরিহারে আইনের প্রয়োগ ও উপযুক্ত কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরকার আর জনগণকে আন্তরিক হতে হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতাবৃদ্ধি যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ তাই বৈশ্বিক উদ্যোগ ছাড়া এই সমস্যা মোকাবিলা করাও সম্ভব নয়। স্বল্প মেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এ লড়াইয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে ব্যক্তি, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, সরকার ও আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়সহ সবাইকে। তবেই অপূরনীয় ক্ষতির হাত থেকে আগামী দিনে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।