প্রকৃতি প্রেমিক শিক্ষক প্রেমানন্দ বিশ্ব শর্মা
নেত্রকোনা থেকে রোখসানা রুমি, বাপ্পি ও রাব্বি
সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষের স্পর্শে প্রকৃতি, প্রকৃতির সান্নিধ্যে মানুষ পারস্পরিক নির্ভরশীলতায় বেঁচে আছে। টিকে থাকার সংগ্রাম উভয়কেই করেছে বৈচিত্র্যময়। প্রকৃতি থেকেই মানুষ খাদ্য ফলাতে শিখেছে, লজ্জা ঢাকবার জন্যে বস্ত্র বানাতে পেরেছে, গাছের লতাপাতা ব্যবহার করে রোগমুক্তির উপায় লাভ করেছে, প্রাণীকে কাছে ডাকবার জন্যে সুর সৃষ্টি করতে শিখেছে, মনের ভাব প্রকাশের জন্যে আঁকতে শিখেছে। প্রকৃতিই মানুষকে শিখিয়েছে কিভাবে দলবদ্ধভাবে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয় পৃথিবীতে। সে অর্থে প্রকৃতি হলো পাঠাশালা। এই পাঠশালা থেকে মানুষ শিখেছে মানুষ হয়ে উঠবার মন্ত্র। শিখেছে আদিম যুগ পারি দিয়ে সভ্যতার এই লগ্নে এসে দাঁড়ানোর।
নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার নোয়াদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রেমানন্দ বিশ্ব শর্মা। তিনি প্রকৃতিকে ভালোবাসেন, প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে চান। প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে চান। তাঁর পাঠ্যক্রমে তাই তিনি প্রকৃতি অগ্রাধিকার দেন। সুযোগ পেলেই ব্যবহারিক শিক্ষা হিসেবে শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ে তিনি গ্রামে যান, গ্রামের ছোট্ট বনে প্রবেশ করেন। বনের ভেতরে নানান ধরনের উদ্ভিদ, গুল্ম, লতাপাতা, বৃক্ষসহ বনের বিভিন্ন উপাদানের সাথে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেন। এসব উদ্ভিদের উপকারিতা, ব্যবহার এবং মানুষের সার্বিক জীবনের তাদের অবদান শিক্ষার্থীদের সাথে সহভাগিতা করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমাদের সবুজের কাছাকাছি থাকতে হবে। তাই আমি গাছ চেনানোর জন্য গ্রামে ঘুরে ঘুরে শিক্ষার্থীদেরকে ফলজ, ঔষধি, বনজ, কুড়িয়ে পাওয়া শাকসবজির সাথে পরিচিত করিয়ে দিই। আমার দেশকে, প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হবে, চিনতে হবে।” তিনি আরও বলেন “মানুষ প্রকৃতি থেকে যতবেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে তত বেশি বিপদাপন্ন হয়ে পড়ছে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তার প্রাকৃতিক জগতকে ভালোবাসতে, রক্ষা করতে, প্রকৃতির সাথে যে মানুষের নির্ভরশীলতা আছে তা বুঝতে হবে। তবেই প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান রক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করবে।”
শিক্ষার্থীদেরকে প্রকৃতির সাথে পরিচিত করতে এবং প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের উপকারিতা সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য তিনি নোয়াদিয়া গ্রামের সুমন কবিরাজকে নিয়ে স্কুলে শিক্ষার্থীদের জন্য এক ঘণ্টার ক্লাশ পরিচালনা করেন। ব্যবহারিক এই পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা গাছের উপকারিতা, গাছের সাথে মানুষ, পাখির, প্রাণীর পারস্পরিক নির্ভরশীলতার কথা জানতে পারে। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় প্রাণী, ফল, ফুল পাখিসহ সবগুলো বিষয়ের ‘মোরাল’ তার বিদ্যালয়ের সামনে তৈরি করে রাখার জন্য পরিকল্পনা করেছেন। প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণ ও সৃষ্টি পরম মমতায় আগলে রাখার তাঁর এই প্রয়াস প্রশংসিত হয়েছে। শিক্ষার্থীদেরকে শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তক ও স্কুলের ভেতরে আবদ্ধ করে রাখলে তারা প্রকৃতি সম্পর্কে মৌলিক শিক্ষা লাভ করতে পারবে না উপলদ্ধি করেই তিনি তাদেরকে গ্রামে, বনে, মাঠে নিয়ে যান। প্রকৃতির পাঠশালায় তাদের ঠেলে দেন। শিক্ষার্থীরাও আনন্দের সাথেই এই শিক্ষা গ্রহণ করেছে। নেত্রকোনার এই শিক্ষকের মতো আমাদের দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ এরকম উদ্যোগ নিতে পারেন। এতে করে ছোটকাল থেকেই শিক্ষার্থীর প্রতি যতœবান হবে, প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানকে ভালোবাসবে। এতে করে রক্ষা পাবে বনের প্রতিটি প্রাণ, পরিবেশ হবে সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্য হবে প্রতুল।