বিলুপ্তির পথে ইকর উদ্ভিদটি
কলমাকান্দা, নেত্রকোনা থেকে অর্পণা ঘাগ্রা
হাওর অঞ্চলে ঘর তৈরির উপকরণ হিসেবে ইকরের বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে। একটা সময় ছিল যখন মানুষ ঘরের বেড়া ও ছাউনি দেয়ার কাজে ইকর, বেতপাতা, সুপাড়ি গাছের পাতা, গোলপাতা, ছন, বাঁশ পাতা, বিন্দা, জেং, প্রভৃতি ব্যবহার করতো। তখন প্রচন্ড গরমেও কোন ধরনের বৈদ্যুতিক ফ্যান ছাড়াই ওইসব ঘরে সারাদিন অবস্থান করা যেতো। কালের বিবর্তনে ঘর তৈরির জন্য টিনের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এই উপকরণগুলো আজ বিলুপ্তির পথে।
তবে স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে এখনও ইকরের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এবং এখনও এই ইকর চাষবাদ করেন এমন কৃষকও রয়েছেন। কারণ ইকর দিয়ে স্বল্প খরচে ঘরের বেড়া দেয়া সম্ভব। তবে ইকর দিয়ে বর্তমানে রান্না ঘর, গোওয়াল ঘর ও ঘরের সীমানা বেড়া দেওয়ার কাজই বেশি হয় বলে নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার কৃষকরা জানান। বেড়া দেয়া ছাড়াও ইকর দিয়ে অনেকে ঝাড়– তৈরি করেন।
কলমাকান্দা উপজেলার তেলিগাও গ্রামের কৃষক মাসুদ বিল্লা (৩৮) বিগত ২০ বছর ধরে ইকর চাষ করেন। উব্দাখালী নদীর পাড়ে তাঁর ১০ কাঠা পরিমাণ জমি রয়েছে। প্রতিবছর বর্ষাকালে জমিটি প্রায় ছয় মাস পর্যন্ত পানির নীচে তলিয়ে থাকে। প্রবল বন্যার সময় পানির ¯্রােতে জমির কিছু কিছু অংশ ভেঙে গিয়ে জমির আয়তন হ্রাস পাচ্ছিল বলে তিনি জানান। তাই নদী ভাঙন থেকে জমি রক্ষার জন্য তিনি নদীর পাড়ে ইকর চাষ করেছেন। এর ফলে নদীর পাড়ের মাটি ক্ষয় রোধ হচ্ছে এবং ফসলী জমি রক্ষা পাচ্ছে বলে তিনি জানান।
মাসুদ বিল্লা প্রথমে তাদের ঘরের পেছনের জমিতে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো ইকরের কিছু চারা নিয়ে রোপণ করেছিলেন। বর্তমানে তা ২-৩ শতাংশ পরিমাণ জমিতে ছড়িয়ে পড়েছে। ইকর চাষ করে প্রতিবছর তিনি কিছু বাড়তি আয়ও করতে পারছেন। বাজারে আটি প্রতি ইকরের মূল্য ২৫০-৩০০ টাকা পর্যন্ত হয়। প্রতিবছর বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে তিনি তার জমিতে চাষ করা ইকরের কিছু অংশ বিক্রি করেন নিজের চাহিদা মেটানোর পর। তিনি জানান, ইকর একবার রোপণ করে রাখলেই হয়। প্রতিবছর গোড়া থেকে কেটে বিক্রি করলেও শেকড় থেকেই আবার গজাতে শুরু করে। তা একবছরেই বিক্রির উপযুক্ত হয়ে উঠে। কোন ধরনের যতেœর প্রয়োজন পড়েনা। বন্যা, খরা, জলাবদ্ধতা কোন কিছুই এর কোন ধরনের ক্ষতি করতে পারে না। গরু ছাগলও তেমন ক্ষতি করে না। পানির মধ্যেই এটি দ্রুত বাড়ে।
ইকর উদ্ভিটি ৮-১০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। এর পাতাগুলো ধানের পাতার মত সবুজ ও পাতার প্রান্তগুলো ধারালো। পাতার উচ্চতা দিয়েই ইকরের উচ্চতা নির্ধারণ করা হয়। এর ফুল লেমা ঝাড়–র ফুলের মত। তবে ফুলের রঙ ঘন খয়েরি। ইকরের বেড়া ৬-৮ বছর পর্যন্ত টেকশই থাকে। কেউ কেউ আবার ইকরের বেড়ার উপর মাটির প্রলেপ দিয়ে দেন। এতে করে ইকরটি আরো সুরক্ষিত থাকে। উই পোকা, ইঁদুর সহজে এটি নষ্ট করতে পারে না বলে হাওর অঞ্চলের মানুষের কাছে এটি এখনও বেশ জনপ্রিয়।
হাওর অঞ্চলে ধানের জমির আইলের ধারে, বসত ভিতের ধারে, নদী, নালা, খাল, বিল ও হাওরের পাড়ে এখনও কিছু কিছু ইকর চোখে পড়ে। যার কিছু কিছু প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো। আবার কিছু কিছু চাষ করা। তবে এটি মাটির ক্ষয়রোধে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। পাশাপাশি মৌসুমী ইকর ব্যবসায়ীদের আয়ের যোগানও দিচ্ছে এবং স্বল্প আয়ের মানুষের স্বল্প খরচে ঘর তৈরির চাহিদাও পূরণ করছে।