বাংলাদেশে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকবিহীন ফসল উৎপাদনের বিপ্লব ঘটুক

বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে অমিত সরকার ও শহিদুল ইসলাম শহিদ

নওগাঁর নাসির উদ্দিন। ২০১৩ সাল থেকে তিনি নিজ বাড়িতে ভার্মি কম্পোস্ট (কেঁচো সার) নামে জৈব সার ও জৈব বালাইনাশক তৈরি করে নিজের জমির পাশাপাশি আশপাশের কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে অর্গানিক ফসল চাষের উদ্যোগ গ্রহণ করছেন। যার ফলে গত বোরো মৌসুমে ১৪ জন কৃষক ১১৫ বিঘা জমিতে জৈব পদ্ধতিতে জিরাশাইল ধানের আবাদ করেন। তানোরের অভিজ্ঞ ও জাতীয় পুরুষ্কারপ্রাপ্ত কৃষক ইফসুফ আলী মোলাøার কাছ থেকে বরেন্দ্র অঞ্চল উপযোগী খরা সহনশীল আমন ধানের জাত সংগ্রহ করে কৃষক নাসির উদ্দিন চাষাবাদে সফলতা পেয়েছেন। অভিজ্ঞ ওই কৃষকের কাছ থেকে তিনি জৈব কৃষিসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষং জানতে পারেন। বিনিময়ে তিনি  বরেন্দ্র  অঞ্চল জলবায়ু সহনশীল জাত ও এবং জৈব কৃষির সফলতাগুলো অন্যান্য কৃষকের মধ্যেও ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তিনি বলেন, “আমার স্বপ্ন একদিন বাংলাদেশে সার ও কীটনাষকবিহীন ফসল উৎপাদনের বিপ্লব ঘটবে। দেশের কৃষকরা একসময় সারবিষ মুক্ত ফসল উৎপাদন করে মাটির উর্বরতা শক্তি ফিরিয়ে আনবে। আমার স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমি কাজ করে যাবো।”
?
কৃষক নাসির উদ্দিনের এই সফলতা ও অভিজ্ঞতার কথা নাচোল, তানোর, গোদাগাড়ীর গোগ্রাম, রিশিকুল, পবা উপজেলার দর্শনপাড়া, বড়গাছীর কৃষকদের কাছে পৌছেছে। তারাও পুনরায় স্থায়িত্বশীল কৃষি চর্চায় আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ওই এলাকার আগ্রহী কৃষকগণ তাঁদের এলাকার খরা এবং দুর্যোগ সহনশীল জাতের প্রসারে রাখছেন ভূমিকা। সম্প্রতি বরেন্দ্র অঞ্চলের নাচোল, তানোর ও গোদাগাড়ী উপজেলার ৯ জন কৃষক নাসির উদ্দিনের এলাকার কৃষকদের সাথে নিজেদের অভিজ্ঞতার বিনিময় করেন। আগ্রহী কৃষকরা সেই এলাকার আম, লিচু, ধান, পটল, সবজিসহ নানা ধরনের মাঠ ফসল জৈব প্রদ্ধতিতে উৎপাদন সরজমিনে পর্যবেক্ষণ করেন। এই প্রসঙ্গে আগব্বরপুর ইউনিয়নের কিসমত ভগবানপুর গ্রামের তিন বিঘার উপর লিচুর বাগানের মলিক মো. আব্দুল জব্বার মন্ডল (৬৫+) বলেন, “গত দুই বছর ধরে আমি আমার বাগানে কেঁচো সার ব্যবহার করছি। নতুন যেগুলো চারা গাছ লাগিয়েছি সবগুলোতে কেঁচো সার দিয়ে মাটি প্রস্তুত করে নিয়ে লাগিয়েছি। লক্ষ্য করে দেখেছি এই গাছগুলো খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বছর ফলও পেয়েছি।” তিনি আরও বলেন, “আমি নাসির ভাইয়ের সাথে আলোচনা করে আমার লিচুতে এখন বাজার থেকে কেনা বিষও ব্যবহার করি না। নিজেই বিষকাঠালি, নিমপাতা, তামাকপাতা, গরুর মূত্র ইত্যাদি দিয়ে বিষ তৈরি করি। পোকার আক্রমণ বুঝে এইগুলো ব্যবহার করি। আমার লিচু এইবার নাসির ভাইয়ের মাধ্যেমে ঢাকা পাঠিয়েছি। দামও ভালো পেয়েছি। আমার লিচুর সুনামও শুনেছি”।

?

কৃষক নাসির উদ্দিনের পরামর্শে গত বছর বোরো মৌসুমে জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারে করেননি কৃষক মো. শাহাজান (৪৫)। তিনি বলেন, “গেলো বোরো মৌসুমে আমি আমার জমিতে কোন রাসায়নিক সার ও বিষ ব্যবহার করিনি। ফলন পেয়েছি ভালো। আমি একটি হিসাব করে দেখেছি আমি আগে একবিঘা (৩৩ শতাংশ) মাটিতে ধান লাগালে ২২ থেকে ২৫ মণ ধান পেয়েছি কিন্তু গেলো মৌসুমে বাজার থেকে সার বিষ না কিনে ধান পেয়েছি ১৮ মণ।” তিনি আরও বলেন, “আমি দেখেছি বাজার থেকে যখন সার বিষ কিনতাম তখন ধান পাওয়ার পরেই আমাকে ৬ থেকে ৭ মণ ধান বাজারে বিক্রি করে সার বিষের ডিলারের কাছে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতাম। কিন্তু সার বিষ ব্যবহার না করায় এবার আমি এই ঋণের জালে পড়িনি। আমি আর রাসায়নিক সার ব্যবহার করবো না”।

কৃষক নাসির উদ্দিনের পরামর্শে জমিতে রাসায়নিক সার ও বিষ ব্যবহার করবেন না বলে জানালেন গোদাগাড়ী উপজেলার রিশিকুল এলাকার কৃষক আব্দুল মজিদ। তিনি বলেন, “নাসির ভাইয়ের এই উদ্যোগ আমার প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। এইখানে এসে বুঝতে পারলাম সারবিষ ছাড়াও ফসল উৎপাদন করা যায়। আমি তো প্রতিবছর শুধু ঘাস মারা বিষ কেনার জন্যই অনেক টাকা খরচ করি। গরুর মূত্র যে জমিতে ঘাস জন্মাতে দেয় না তা আমি জানতামই না।” একইভাবে নাচোলের কৃষক মো. জুয়েল রানা, তানোরের কৃষক জীতেন্দ্রণাথ সুত্রধরসহ অনেক কৃষকই জৈব কৃষি চর্চার ভালো দিকগুলো হাতেকলমে জেনে এই কৃষি চর্চার আগ্রহ প্রকাশ করেন।

বরেন্দ্র অঞ্চলের তানোর উপজেলার দুবইল গ্রামের কৃষক ইফসুফ আলী মোল্লা, তানোর সদরের নুরুজ্ঝামান মিয়া এবং নওগাঁ পতœীতলা উপজেলার নাসির উদ্দিন। এই তিনজন অভিজ্ঞ কৃষক স্থায়িত্বশীল কৃষি চর্চা করে সফলতা লাভ করে অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। তাঁদের দেখানো পথ আরও অনেক কৃষক অনুসরণ করে রাসায়নিক ও কীটনাশকনির্ভর পরিবেশবিনাশী কৃষিকে বিদায় জানানোর প্রস্তুতি নিয়েছেন! অভিজ্ঞ কৃষক তানোরের ইউসুফ মোল্লার জৈব কৃষির সাফল্যে অনুপ্রাণীত হয়ে নওগাঁর কৃষক নাসির উদ্দিন জৈব কৃষির চর্চা শুরু করেন। একইভাবে কৃষক নুরুজ্জামান মিয়া তাদের সাফল্যে অনুপ্রাণীত হয়ে জৈব কৃষি চর্চা করে সফলতা লাভ করেছেন। জৈব কৃষি চর্চায় এই তিনজন কৃষকের সাফল্যে অন্য কৃষকরা আশান্বিত হয়েছেন যে, তারা রাসায়নিক ও কীটনাশকনির্ভর কৃষির মায়াজ্¦াল থেকে নিজেদের উদ্ধার করবেন; উৎপাদন খরচ হ্রাস করাবেন এবং পরিবেশকে, মাটিকে সুস্থ করার মধ্য দিয়ে সবার ভালো থাকা নিশ্চিত করবেন।

happy wheels 2