জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় প্রাকৃতিক সম্পদ
নেত্রকোনা থেকে মো:সুয়েল রানা
নেত্রকোনা জেলার সদর উপজেলার চল্লিশা ইউনিয়নের গ্রাম বামনমোহা। এই গ্রামের পূর্ব-পশ্চিম উভয়দিকে বিল দিয়ে ঘেরা। বিলের নাম গইনচাতল বা গোবিন্দ বিল চাতল। নেত্রকোনার স্থানীয় জনগণের কাছে বিলটি পল বাওয়ার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। প্রতিবছর বিলটিতে অনেক দূরদূরান্ত থেকে মাছ সংগ্রহের জন্য ছুটে আসেন অনেকে। পলবাওয়ার জন্য ২ থেকে ৩টি স্থান আছে। বিলে পলোবাওয়াকে কেন্দ্র করে সংঘাত হয়েছে, অনাকাঙিাখত ঘটনাও ঘটেছে ইতিপূর্বে। বিলটিকে ঘিরে অনেক কিচ্ছা/গল্প আছে। তাছাড়া প্রায় ৫মাস গ্রামের মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণের অনন্য উৎস এই বিলটি। হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসবের র্তীথস্থান হিসাবে অষ্টমী ¯œান, বান্নী মেলা ও বসে বিলের পাড়ে।
বামনমোহা গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ কৃষি পেশার সাথে জড়িত। বাড়ির আশপাশে সবজি আর বিল জমির ধান চাষ জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উৎস। যদি ভাগ্য মন্দ না হয় আর সৃষ্টিকর্তা সহায় থাকে, তাহলে এলাকার মানুষ নিজের খাদ্য চাহিদা পূরণে ধান তুলতে পারেন ঘরে। নিচু এলাকা বিধায় বাড়ির আশপাশ ছাড়া সবজি চাষ দেখা যায় না বললেই চলে। সবজির বাগানে যে পরিমাণ খরচ, শ্রম ব্যয় হয় অনিয়মিত বৃষ্টি, ঘন কুয়াশা, পোকারঁ আক্রমণ নানান কারণে নষ্ট হয়ে যায়। নিজের পুঁজি তুলতে পারেনা।
বিগত ২ বছর যাবৎ একেরপর এক প্রাকৃতিক দূর্যোগে মানুষের নিত্যদিনের চাহিদা পূরণ করতেও ব্যর্থ হচ্ছেন। একই বছরে র্দীঘস্থায়ী বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, বন্যায় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। একের পর এক দুর্যোগ সামলে উঠতে পারছেন না তারা। ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন প্রতিনিয়ত। ভৌগলিক অবস্থানের কারণে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব গ্রামের কৃষকরা বারবার কৃষি থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য, জীবিকা, পুষ্টি, খাদ্য নিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ততার সন্মূখিন হচ্ছে। জীবিকার তাগিদে টিকে থাকার লড়াইয়ে নিজেদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কখনো কচুরিপানা, কখনো বাড়ির উঠানে বীজতলা করে, কখনো হাসঁ-মুরগি পালন করে চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
তারপরও জীবন ও জীবিকার তাগিদে কয়েকজন কৃষক প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন নিজের জ্ঞান, অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে। বিল এলাকার দরুণ প্রচুর পরিমানে কচুরিপানা জন্মায় বামনমোহা গ্রামে। আগ্রহী কৃষক আব্দুল কাইয়ুম নিজের পুকুর পাড়গুলো বাবার সাথে কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে দিয়ে সেখানে ডাটা, লাউশাক, কুমড়া, পেঁপে, মিষ্টি কুমড়া চাষ করেন। প্রায় ৫০ হাজার টাকার সবজি বিক্রি করতে পেরেছিলেন। তিনি লক্ষ্য করেন কচুরিপানাতে সবজি করলে বাড়তি কোন খরচ করতে হয় না, ফলন বেশি হয়, খেতে স্বাদ লাগে, বাজারে প্রচুর চাহিদা। এরপর থেকে কচুরিপানা দিয়ে সবজি শুরু করেন। তাছাড়া বর্ষাকালীন সময়ে যেহেতু জমি পানির নিচে থাকে সেজন্য কচুরিপানার বল বানিয়ে ভাসমান বেড তৈরি করে সবজি চারা করেন। পানি সরে যাওয়ার পর রোপণ করলে সবজি উৎপাদনের সময় ঠিক থাকে, চারাগুলোও সুন্দর গজায়। সেই থেকে কচুরিপানার চর্চাটা তিনি ধরে রাখেন। নিজের অভিজ্ঞতাকে আরো সৃদৃঢ় করতে কচুরিপানার ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা তথ্য নেওয়া শুরু করেন। নিজের অভিজ্ঞতা ও প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে টিকে থাকার কৌশল আয়ত্ব করতে বারসিক, কৃষি দিবানিশিতে কচুরিপানা ব্যবহার করে ভাসমান সবজি চাষের ব্যবস্থাপনা বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ শুরু করেন।
এরপর থেকে বর্ষা মৌসুমে নিজের পুকুরে কচুরিপানা এক জায়গায় জমা করেন। কলাগাছ, বাঁশ দিয়ে ভেলা তৈরি করে সবজি চাষ ও সবজি চারা উৎপাদন করে। তাছাড়া পুকুরের পাড়ে যেহেতু সারাবছর সবজি করে তার জন্য পাড়ে গর্ত করে কচুরিপানা জমা করে পঁচিয়ে তারপর বীজ বপন করেন। কচুরিপানা জমিতে মালচিং হিসাবে ব্যবহার করেন।
তার এই চর্চা এলাকার কৃষকের নজরে পড়ে এবং আগ্রহী কৃষক মো: হামিদ মিয়া উদ্বূদ্ধ হয়ে বাড়িতে কচুরিপানার বল তৈরি করে লাউ, কুমড়া চারা করেন। বিলে কচুরিপানার বেড তৈরি করে প্রথমে শাক জাতীয় বীজ বপন করেন এবং পরে পানি সরে যাওয়ার পর লাউ, কুমড়া চারা বপন করে সবজি করেন। তাছাড়া বিলের পাড়ে গর্ত করে কচুরিপানার পঁিচয়ে সবজি চাষের উদ্যোগ নেন। চলতি সময়ে ভাসমান সবজির জন্য কচুরিপানার বেড করার পর আশি^ন মাসের বন্যায় নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পরবর্তীতে আবারও ব্যক্তি ও যৌথ উদ্যোগে কচুরিপানা দিয়ে বেড করে সবজি চাষের চর্চা শুরু করেন।
বর্তমান সময়ে বামনমোহা গ্রামের কৃষকরা কচুরিপানাকে অভিশাপ মনে না করে আর্শীবাদ হিসাবে নানাবিধ ব্যবহার শুরু করেছেন। প্রাণীসম্পদের খাদ্য হিসাবে ব্যবহার, কম্পোষ্ট হিসাবে, মালচিং পদ্ধতিতে উপকরণ হিসাবে কচুরিপানা ব্যবহার করছেন অনেকে। গ্রামের মানুষ জানান, পারিবারিক চাহিদা মিটিয়ে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যায়। তাছাড়া অনাবাদি জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে চলতি বছর আরো ৯ জন (আব্দুল হামিদ, শামচ্ছুজ্জামান, বাচ্চু মিয়া, নিলয়, একরাম হোসেন, আব্দুল কাসেম, হারুন, মাসুদ,কামরুল) কৃষক কচুরিপানার ভাসমান বেড তৈরি করে এবং গর্ত করে কচুরিপানা পচিয়ে, কম্পোষ্ট করে সবজি চাষ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। কৃষকরা লাউ, মিষ্টিকুমড়া, সরিষা, মরিচ, ডাটা, লালশাক, মূলা, করলা, চালকুমড়া চাষ করেছেন।
আজ প্রকৃতির সাথে দূরত্বের ভুক্তভোগী আমরা। দীনতা আমাদের ঘিরে ধরছে। ব্যর্থতার গ্লানি মুছে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পের সৃষ্টি করে আমাদের কৃষকরা। এত কিছুর মধ্য থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখে বামনমোহার কৃষকরা। উদাহরণ বা অনুপ্রেরণা যোগায় তাদের আন্তঃনির্ভরশীলতা, পরষ্পর-পরষ্পরকে সহযোগিতার, জ্ঞান- অভিজ্ঞতা ও পরস্পরবিনিময় প্রথার, লোকায়ত জ্ঞান অভিজ্ঞতার, পরিবেশবান্ধব চর্চার। আমাদের আগামী পথ প্রদর্শক এসব কৃষকরা। প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার , প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ , প্রাণীসম্পদ বর্ধন, কৃষক-কৃষাণীদের সহযোগিতা, বিনিময়, সবজিচাষ, বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, বর্ধন সংগঠনের মাধ্যমে অধিকার আদায় দারিদ্রতা দূরীকরণে তাদের সফলতা অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা দিবে। জননিয়ন্ত্রিত উদ্যোগের ভেতর দিয়ে সর্বজনীন সামাজিক, প্রাকৃতিক সম্পদ ও কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্যে গ্রামীণ নারী পুরুষের জলবায়ু ন্যায্যতা নিশ্চিত করবে।